নারীরা সারাদিন কাজ করেন, তারপরও তাদের বেকার বলা হয়। কারণ, “বেকার” শব্দটি কাজের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং চাকরির সাথে। আপনি যতই উন্নতমানের কাজ করুন না কেন, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, নির্দিষ্ট কারো অধীনে কাজ না করেন, তাহলে আপনাকে বেকার বলা হবে। যেহেতু নারীরা নির্দিষ্ট সময়ে কারো অধীনে চাকরি করেন না, তাই তাদের বেকার বলা হয়।
“বেকার” শব্দটি নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি অপবাদ। একজন নারী বা পুরুষ নিজে অনেক কাজ করলেও, যদি তারা কারো অধীনে চাকরি না করেন, তাহলে তাদের বেকার বলে অপমান করা হয়। অথচ অন্যের অধীনে চাকরি করা আমাদের জন্য সবসময় সম্মানজনক নয়।
আমরা সম্মানিত হবো তখনই, যখন সম্মানজনক কাজ করবো। আর এর জন্য অন্যের অধীনে চাকরি করা বাধ্যতামূলক নয়। চাকরি ছাড়াও সম্মানজনক কাজ করা সম্ভব।
সম্মানজনক কাজের সঙ্গে টাকারও সম্পর্ক নেই। টাকা ছাড়াও সম্মানজনক কাজ করা যায়।
ধরুন, আমি যদি জিজ্ঞাসা করি, “একটি বাড়ি এবং একজন মানুষ এই দুটির মধ্যে কোনটি বেশি সম্মানিত?” আপনি বলবেন, “মানুষ।” সে হিসেবে, একটি বাড়ি নির্মাণ এবং একজন মানুষকে লালন-পালন করার মধ্যে কোন কাজটি বেশি সম্মানজনক? অবশ্যই মানুষকে লালন-পালন করা।
মানুষ লালন-পালনের মতো সম্মানজনক কাজের জন্য শুধু ইচ্ছাই যথেষ্ট। এর জন্য কারো অধীনে চাকরি করা বা টাকা-পয়সার দরকার নেই। কিন্তু আমাদের সমাজ মানুষ লালন-পালনকে কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। যারা সন্তান লালন-পালন করেন, তাদের বেকার বলা হয়। অপমান করা হয়।
একটি নিম্ন চেতনাসম্পন্ন বাড়ি নির্মাণকে যতটা সম্মানজনক মনে করা হয়, আমাদের সমাজ একটি উচ্চ চেতনাসম্পন্ন মানুষ নির্মাণকে ততটা সম্মানজনক মনে করে না। কেন?
এর দুটি কারণ আছে।
প্রথমত, আমরা শুধু টাকাকেই সম্পদ মনে করি। সম্পর্ক, সমাজ, সম্মান, সন্তান এবং সময় এগুলোকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করি না। অথচ যেটা টাকা দিয়ে অর্জন করা যায়, সেটাই সম্পর্ক, সমাজ, সম্মান, সন্তান বা সময় দিয়ে অর্জন সম্ভব, এটা আমরা ভুলে যাই।
দ্বিতীয়ত, আমরা মানুষকে কেবল টাকার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করি, কাজের ভিত্তিতে নয়। একজন গরিব নারী যদি একজন সন্তানকে লালন-পালন করার জন্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যান, ব্যাংক তাকে বিশ্বাস করবে না, ঋণ দেবে না। মানুষ নির্মাণের মত একটা মহান কাজের সুযোগ দিবে না। অন্যদিকে, একজন অসৎ মানুষও যদি বাড়ি নির্মাণ করার জন্যে ব্যাংকে যায়, ব্যাংক তাকে বিশ্বাস করবে এবং ঋণ দেবে। বাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা করবে।
সবকিছুকে টাকার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার ফলে আমরা কাজ এবং অকাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারি না। এর ফলস্বরূপ, অনেক সম্মানজনক কাজকেও অকাজ বা বেকারত্ব বলে মনে করি। যেমন, সন্তানকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলাকে অনেকেই বেকারত্ব বলে গণ্য করেন। অথচ এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ নির্মাণের কাজ।
মূল কথা হলো, যারা সন্তান লালন-পালন করেন, সন্তানকে সম্পদে পরিণত করেন, তারা আসলে বেকার নন। তারাও সমাজ ও সম্পদ উন্নয়নের জন্য সন্তান গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন।
কুরআনে সন্তানকে সম্পদের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا
“ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হলো পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। তবে স্থায়ী সৎকর্মসমূহ আপনার পালনকর্তার কাছে প্রতিদান প্রাপ্তি ও আশা লাভের জন্যে উত্তম।” (১৮/সূরা কাহাফ: ৪৬)
সন্তান ও সম্পদ এই দুটোই মানুষের জীবনে সুখের কারণ। কিন্তু দেখুন, যারা সম্পদ নির্মাণের কাজ করছেন, তাদের ‘বেকার’ বলা হয় না। অথচ যারা মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত, তাদের ‘বেকার’ বলা হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিক।
কেউ বলতে পারেন, নারীরা উচ্চ চেতনাসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলেন বলে তারাই সেরা। আবার কেউ বলতে পারেন, পুরুষেরা আধুনিক যন্ত্র, বস্তু এবং সম্পদ তৈরি করেন বলে তারাই সেরা। কিন্তু ইসলাম এমনভাবে কাউকে সেরা বা অধম হিসেবে মূল্যায়ন করে না।
একজন মানুষ সম্পদ নির্মাণ করছেন নাকি সন্তান লালন-পালন করছেন, তার ভিত্তিতে ইসলাম তাকে সম্মান বা অপমান করে না। ইসলাম দেখে তিনি কাজ করছেন কিনা। নারী বা পুরুষ কেউ সৎ কাজ করলে তাঁর সম্মান ও প্রতিদান দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য করে না ইসলাম। সন্তান বা মানুষ লালন-পালন করেন বলে নারীদেরকে বেকার বলে না ইসলাম।
আল্লাহ বলেন:
وَمَن يَعمَل مِنَ الصَّالِحَاتِ مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُو۟لَـٰئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا
“পুরুষ হোক বা নারী হোক, যেই সৎ কাজ করবে, সেই বিশ্বাসী। এবং তাঁরা সবাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাঁদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম বা বৈষম্য করা হবে না”। [সূরা ৪/নিসা – ১২৪]
এই আয়াতে স্পষ্ট যে, নারী হোক বা পুরুষ হোক, মানুষকে তার কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। এবং সেখানে নারী বা পুরুষের মাঝে বিন্দু পরিমাণ কোনো বৈষম্য করা হবে না।
পুরুষ অন্যের অধীনে চাকরী করলে তিনি সম্মানিত হবেন, আর নারী নিজের ইচ্ছায় নিজের ঘরে সন্তান লালন-পালনের কাজ করলে তাকে বেকার বলে অপমান করা হবে, এমন ধারণা ইতিহাসবিরোধী, অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক, অন্যায় এবং ইসলাম বিরোধী চিন্তা।
লেখক: জোবায়ের আল মাহমুদ
Leave a Reply