এ পৃথিবী মূলত পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এই পরীক্ষার চূড়ান্ত পরিণতি পুরস্কার ও শাস্তি। পুরস্কার ও শাস্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নির্ধারিত কিয়ামত দিবসের চূড়ান্ত প্রমাণের জন্য (যেভাবে বৈজ্ঞানিক কোনো বিষয়াদির সত্যতা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারে (laboratory) ফেলে প্রমাণ পেশ করা হয়।) এই দুনিয়াতেই কিয়ামতে ছুগরা (قیامت صغریٰ) বা ছোটো কিয়ামত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কায়েম করে দেখিয়েছেন।
এর জন্য আল্লাহ তায়ালা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা হলো আল্লাহ তায়ালা যে জাতির কাছে চাইতেন তাঁর রাসূল প্রেরণ করতেন। রাসূলগণ তাদের জাতির কাছে ইতমাম আল হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) পেশ করতেন। এরপর পরিপূর্ণ ইনসাফের সাথে তাদের ফায়সালা এই পৃথিবীতেই করে দেয়া হতো। এই ফায়সালা এভাবে বাস্তবায়িত হত যে, যারা রাসূলদের উপর ঈমান আনয়ন করেছিল তাদেরকে নাজাত দেয়া হতো এবং অস্বীকারকারীদের জন্য এই পৃথিবীতেই আল্লাহ তায়ালার আজাব নাযিল করা হতো। যার ফলে রাসূলদের ঐ অস্বীকারকারীদের জমিন থেকে চিরতরে মুছে দেয়া হতো অথবা তাদেরকে চিরস্থায়ী পরাধীনতার লাঞ্ছনাময় জীবনের শাস্তিরর দিকে নিক্ষেপ করা হতো।
পবিত্র কুরআনে হযরত নূহ (আ)-এর জাতি, আদ ও সামুদ জাতি, হাযরত লূত (আ)-এর জাতি ইত্যাদি এ ধরনের আরও বিভিন্ন জাতির যেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তা এই শাস্তিরই বিবরণ।
কুরআনে বলা হয়েছে, রাসুলগণের তরফ থেকে ইতমাম আল হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) পেশ না করা পর্যন্ত এই শাস্তি কখনোই কোনো জাতির উপর আসেনি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
আমি ততক্ষণ পর্যন্ত শাস্তি দেই না, যতক্ষণ না একজন রাসুল পাঠাই। (সূরা বনী ইসরাঈল: ১৫ )
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে এই ইতমাম আল হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) কীভাবে পেশ করা হয়ে থাকে? পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে জানা যায় এর জন্য তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি।
১. আল্লাহর রাসূল পৃথিবীতে উপস্থিত থাকবেন এবং তিনি কোনো জাতিকে তার উপর ঈমান আনার জন্য আহ্বান জানাবেন।
২. আহ্বানকৃত ঐ জাতিকে এই পরিমান অবকাশ দেয়া হবে তারা যদি চায় তাহলে রাসুলকে এসে স্বচক্ষে দেখতে এবং তার মুখ থেকে আল্লাহ তায়ালার পয়গাম সরাসরি শুনতে পারবেন।
ফার্সি স্তবক: روے و آواز پیمبر معجزہ ست
পয়গাম্বরদের চেহারা ও কথা মুজেজা স্বরূপ।
৩. রাসূল এবং তাঁর সাথী-সঙ্গীদের সাথে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্ক ও সাহায্যের বহিঃপ্রকাশ তাদের চোখের সামনেই এমনভাবে ঘটে যাবে এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো মতামত কায়েম করার সুযোগ থাকবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
যাতে এই রাসুলদের সতর্ক করার পর মানুষের জন্য আল্লাহর সামনে কোনো ওজর পেশ করার সুযোগ না থাকে। (সুরা নিসা: ১৬৫)
এরপরই অস্বীকারকারীদের উপর শাস্তি এসে যায়। যদি রাসূল ও তার সঙ্গী-সাথীদের শক্তি ও সামর্থ্য থাকে তাহলে অস্বীকারকারীদের উপর এই শাস্তি প্রয়োগ করার জন্য রাসুলের অনুসারীদেরকে; আর তাদের শক্তি ও সামর্থ্য না থাকলে ফেরেশতাদেরকে এই শাস্তি কায়েম করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম দেয়া হয়। নবী মুহাম্মদ (সা)ও আল্লাহ তায়ালার রাসুল ছিলেন আর পৃথিবীর বুকে শেষবারের মতো এই কিয়ামতে ছুগরা বা ছোটো কিয়ামত সংঘটিত করার জন্য আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছিলেন। তাই রাসুল (স)-এর পক্ষ থেকে ইতমাম আল হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) সম্পন্ন হওয়ার পর তার সাহাবীদেরকেও হুকুম দেয়া হয়েছিল তারা যেন রাসুল (স) এর অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহ তায়ালার শাস্তির এ ফায়সালা প্রয়োগ করে।
এই বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আরবের মুশরিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
এরপর যখন হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন তোমরা এসব মুশরিকদেরকে যেখানে পাও সেখানে হত্যা করো, আর (এ উদ্দেশ্যে ) তাদেরকে ধরো, তাদেরকে ঘেরাও করো এবং প্রত্যেক ওঁৎ পাতার জায়গায় তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকো। এরপর তারা যদি তাওবা করে নেয় আর যত্ন সহকারে নামাজ পড়তে শুরু করে এবং যাকাত দান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, সদা দয়ালু। (সুরা তাওবা: ৫)
একইভাবে আরবের আহলে কিতাবদের সম্পর্কেও বলা হয়েছে:
ঐ সব আহলে কিতাবিদের সাথেও তোমরা যুদ্ধ করো যারা আল্লাহর প্রতিও ঈমান আনে না এবং পরকালের প্রতিও ঈমান আনে না। আর আল্লাহ যা হারাম সাব্যস্ত করেছেন তা হারাম মনে করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন বানায় না, (এদের সাথে যুদ্ধ করো) যতক্ষণ না তারা নিজ হাতে কর দেয় এবং অধীনস্থ হয়ে থাকে। (সুরা তাওবা: ২৯)
এসব আয়াতের প্রসঙ্গ, প্রেক্ষাপট ও পূর্বাপর যোগসূত্রের আলোকে এ কথা স্পষ্ট যে, এই হুকুম মূলত আরবের মুশরিক ও আহলে কিতাবদের জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। কিন্তু আমরা দেখতে পাই রাসুল (স) এর সাহাবীদের মধ্যে যারা তার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তারা আরব উপদ্বীপের বাইরের কিছু জাতির সাথে এই একই কাজ করেছেন। এটি স্পষ্টতই একটি ইজতিহাদি ফায়সালা ছিলো যাকে ভুল অথবা সঠিক বলা যেতে পারে। তবে আমার মতে সাহাবায়ে কেরাম (রা)-দের এ ফায়সালা সম্পূর্ণরূপে সঠিক ছিলো। এর প্রমাণ হলো রাসূলদের পক্ষ থেকে কোনো জাতির উপর ইতমাম আল হুজ্জাত সম্পন্ন হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উপরে বর্ণিত হয়েছে সেসব শর্ত এই জাতিগুলোর ক্ষেত্রে সব দিক থেকে পূরণ হয়ে গিয়েছিল।
কীভাবে তা হয়েছিল এর বিস্তারিত বিবরণ হলো:
১. রাসুল (স) জীবিত থাকা অবস্থায় তার বার্তাবাহক প্রেরণ করে এই সকল জাতিকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছিলেন। রিসালাতের যুগের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত প্রত্যেকটি ব্যক্তি জানেন রাসুল (স) ঐ সকল জাতির শাসকদেরকে চিঠির মাধ্যমে অবগত করেছিলেন। বলেছিলেন তিনি আল্লাহ তায়ালার রাসূল এবং তার পক্ষ থেকে ইসলামের দাওয়াত পৌছাবার পর দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের নিরাপত্তার জন্য কেবলমাত্র ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। রাসুল (স) এসকল চিঠি আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশী, মিশরের রাজা মাকওয়াকাস, পারস্যের রাজা খসরু পারভেজ, রোমের রাজা হেরাক্লিয়াস, বাহারাইনের রাজা মুনযির বিন সাবী, ইয়ামামার শাসক হাওযা বিন আলি, দামেস্কের রাজা হারিস বিন আবি শামার এবং ওমানের রাজা জায়ফরের কাছে লিখেছিলেন। এসকল রাজা-বাদশাদের কাছে লিখিত চিঠিগুলোর বক্তব্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আমি এখানে রোমের রাজা হেরাক্লিয়াসের প্রতি রাসুল (স) কর্তৃক লিখিত চিঠিটি উল্লেখ করছি। এর মাধ্যমে পাঠক বুঝতে পারবেন এসকল চিঠি কেমন বাকশৈলী, কতটা উচ্চতা ও মনোবল নিয়ে লেখা হয়েছিল।
রাসুল (স) লিখেছেন:
পরম করুণাময় সদা দয়ালু আল্লাহর নামে। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরোক্লিয়াসের প্রতি।
যে হেদায়েতের অনুসরণ করে তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আমি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান করছি। তুমি ইসলাম গ্রহণ করে নাও, তাতে নিরাপদ থাকতে পারবে। আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেবেন। আর যদি তুমি বিমুখ হয়ে যাও তাহলে তোমার প্রজাদের পাপের দায়ও তোমার উপর বর্তাবে।
হে আহলে কিতাব! এমন একটি কথার দিকে এসো যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান; আর তা হচ্ছে এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করব না, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করব না,আর আমাদের মধ্যে একজন অপরজনকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রভু বানাব না। এরপর যদি তারা বিমুখ হয়ে যায় তাহলে তোমরা বলে দাও যে, সাক্ষী থাক–আমরা মুসলমান। (সহিহ বুখারী হাদিস নং: ৭)
২. এসমস্ত চিঠি রাসুল (স) হুদায়বিয়া থেকে ফিরে এসে ৭ হিজরির মহররম মাসে লিখেছিলেন। এ চিঠিগুলো লেখার পর রাসুল (স) কম-বেশি চার বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। এমনকি এই সময় তিনি তাবুক সফর করেছিলেন যা রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে কোনো আক্রমণের আশঙ্কায় করা হয়েছিল। এটা কম সময় নয়। ঐ সকল জাতির লোক এবং তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যদি ইচ্ছে করতেন তাহলে রাসুল (স) -এর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতেন এবং আল্লাহ তায়ালার জমিনের উপর তাঁর সর্বশেষ পয়গাম্বরকে স্বচক্ষে দেখতে পারতেন।
৩. রাসুল (স) এবং তার সাহাবা (রা)-দের সাথে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্ক ও সাহায্যের বহিঃপ্রকাশ বদর, ওহুদ, আহজাব ও খায়বারের যুদ্ধে আরবের মুশরিক ও আহলে কিতাবদের সামনে ঘটেছিল। যার ফলে তাদের জন্য শাস্তির ফয়সালা ঘোষণা করা হয়েছিল। রাসুল ও তার সাহাবীদের সাথে আল্লাহর এ সম্পর্ক ও সাহায্যের বহিঃপ্রকাশ ঐ সব জাতির জন্যও প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল যখন কুরআনের সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী মক্কার কুরাইশরা তাদের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়ে যায়। কুরাইশ নেতাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়। মক্কা মুসলমানরা বিজয় করে নেয়। আল্লাহ তায়ালার গৃহের তত্ত্বাবধান কুরাইশদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। আরবের লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করে। দ্বীন-ইসলাম বিজয় লাভ করে। আল্লাহর শরিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং দ্বিতীয় কোনো ধর্মের কর্তৃত্ব আরব ভূখণ্ডে অবশিষ্ট থাকেনি। শুধু তাই নয় ,আরব ভূখণ্ডের বাইরের এসব জাতির বিরুদ্ধে যখন অভিযান শুরু করা হয় তখন তাদের রাজ্যগুলো বালুকারাশির মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে বাতাসে উড়ে যায়। ঐ সকল জাতির শাসকদের বলে দেয়া হয়েছিল যে রাসুল (স)-এর তরফ থেকে যখন ইতমাম আল হুজ্জাত সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন তাদেরকে অবশ্যই অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে, অন্যথায় আল্লাহর জমিনে তাদের শাসনকর্তৃত্ব থাকতে পারে না। এ সমস্ত বিষয় ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য ঘটনা যা ঐ সকল জাতির লোকদের চোখের সামনে ঘটেছিল। সাহাবায়ে কেরাম (রা) যা করেছেন তা এসব বিষয়ের ভিত্তিতেই করেছেন। তারা ঐসকল জাতিদের দাওয়াত দেয়ার সময় অবশ্যই এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণও করে থাকবেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা)-এর প্রতি এই ভুল ধারণা পোষণ করা উচিত হবে না যে, তারা এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই কেনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ফেলেছেন।
লেখক: উস্তাদ জাভেদ আহমদ গামিদি সাহেব
বই: মাকামাদ
অনুবাদ: আলমানার ইনস্টিটিউট
Leave a Reply