নামাজ না পড়লে প্রহার, ইসলাম কী বলে?

admin Avatar

আমাদের মুসলিম সমাজে এই ধারণা প্রচলিত আছে যে, সন্তানদের ১০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পরেও যদি নামাজ আদায় না করে, তবে অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো সন্তানদের প্রহার করা, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নামাজ আদায় না করবে। এর দলিল হিসেবে কিছু হাদিস উদ্ধৃতি করা হয়। এই পর্যায়ে আমরা এই হাদিসগুলো সম্পর্কে আলোচনা করব। আসলেই কী ইসলামে শিশুদের নামাজ আদায় না করার অপরাধে প্রহার করতে বলা হয়েছে?

এই মর্মে প্রথম যে হাদিসটি উদ্ধৃতি করা হয় তা নিম্নরূপ:

عن عمرو بن شعيب، عن أبيه، عن جده، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ”مروا أولادكم بالصلاة وهم أبناء سبع سنين، واضربوهم عليها وهم أبناء عشر سنين، وفرقوا بينهم في المضاجع

আমর বিন শুয়াইব থেকে, তার পিতার সূত্রে, তার দাদার সূত্রে, তিনি বলেন “আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমাদের সন্তানদেরকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দাও যখন তারা ৭ বছর বয়সে পৌঁছায় এবং ১০ বছর বয়সে নামাজ না পড়ার জন্য তাদের প্রহার করো এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।” (আবু দাউদ)

প্রথমে আমরা উল্লিখিত হাদিসটির সনদ যাচাই করে দেখব এটা সহিহ কিনা। এই হাদিসটি সম্পর্কে আমরা যাচাই করে দেখেছি যে, গোটা হাদিসশাস্ত্রের মধ্যে কেবলমাত্র ২ জন সাহাবি এটা বর্ণনা করেছেন। তারা হলেন: সাবরাহ বিন মাবাদ আল-জুহনি (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)।

প্রথম সাহাবি সাবরাহ বিন মাবাদ আল-জুহনি (রা.) থেকে এই বিষয়ে যত বর্ণনা রয়েছে, তার সবগুলো মুহাদ্দিসগণের নিকট দুর্বল হিসেবে বিবেচিত। এসব বর্ণনা দুর্বল হওয়ার মৌলিক কারণ হলো, এই হাদিসের সনদে বর্ণনাকারী হিসেবে আব্দুল মালিক ইবনুর-রাবি আল জুহানী উপস্থিত রয়েছেন।

রিজাল শাস্ত্রে তার সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে:

إسناد ضعيف، فيه عبد الملك بن الربيع الجهني وهو ضعيف الحديث

“আব্দুল মালিক ইবনুর-রাবি আল জুহানি বর্ণনাকারীদের মাঝে থাকলে তা দুর্বল সনদ এবং তিনি হাদিসে দুর্বল।” (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ ও সুনানে তিরমিজি প্রভৃতি গ্রন্থে এমন বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে)।

দ্বিতীয় সাহাবি হলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-এর মারফতে বর্ণিত এই হাদিসটি প্রথমে ইমাম মালিকের ‘আল-মুদাওয়ানাতুল কুবরা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়। হাদিসটি হলো:

وقال مالك: تؤمر الصبيان بالصلاة إذا أثغروا. قال سحنون، عن ابن وهب، عن عبد الله بن عمرو بن العاص، وسبرة الجهني أن رسول الله ﷺ قال: ”مروا الصبيان بالصلاة لسبع سنين، واضربوهم عليها لعشر سنين، وفرقوا بينهم في المضاجع

মালেক বলেন “বাচ্চাদের নামাজ পড়ার নির্দেশ দাও যখন তাদের দুধের দাঁত পরে যায়।’’ সাহনুন ইবনে ওহাব, আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আস থেকে এবং তিনি সাবরাহ আল-জুহনি থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমাদের সন্তানদের বয়স ৭ বছর হয়, তারপর তাদেরকে নামাজ পড়তে আদেশ করো এবং যখন তারা ১০ বছর বয়সে পৌঁছাবে তখন যদি তারা নামাজ না পড়ে, তবে তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।’’ (আল-মুদাওয়ানাতুল কুবরা, ১/১৩২)

এই বর্ণনায় উভয় সাহাবির নাম একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত উপরে উল্লিখিত হাদিস দুইটি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এই হাদিসের সমস্যা হলো: এর একজন বর্ণনাকারী রাবি ‘ইবনে ওহাব’, যার জন্মতারিখ ১২৫ হিজরি। অথচ তিনি যে সাহাবিদের থেকে বর্ণনা করছেন তারা উভয়েই ২৫ হিজরির আগে ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং এই হাদিসের সনদ বিচ্ছিন্ন, তাই এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

এই কারণে ইমাম মালেক এই বর্ণনাকে তার প্রধান গ্রন্থ মুওয়াত্তায় উল্লেখ করেননি।

এরপর আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল-আস (রা.)-এর মারফতে সরাসরি যে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে তা প্রথমে ‘মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। মুসান্নাফে উল্লিখিত রয়েছে:

عن داود بن سوار، عن عمرو بن شعيب، عن أبيه، عن جده، قال: قال نبي الله ﷺ: ”مروا صبيانكم بالصلاة إذا بلغوا سبعا واضربوهم عليها إذا بلغوا عشرا وفرقوا بينهم في المضاجع

দাউদ বিন সুওয়ারের সূত্রে, আমর বিন শুয়াইবের সূত্রে, তার পিতার সূত্রে, তার দাদার সূত্রে, তিনি বলেন “আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আপনার সন্তানদের ৭ বছর বয়সে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন এবং ১০ বছর বয়সে নামাজ না করার জন্য তাদের প্রহার করুন এবং তাদের বিছানায় আলাদা করে দেন।’’ (মুসান্নাফ, ৩৩৯৪)

প্রকৃতপক্ষে এই একই হাদিস পরবর্তী হাদিস গ্রন্থগুলোতে গৃহীত ও লিপিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি অনেক আলেম এটাকে ‘হাসান-লিগাইরিহি’ মর্যাদায়ও ভূষিত করেছেন। আর এভাবে বর্ণনাটি গ্রহণ করায় এটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সঠিক বর্ণনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই হাদিস সম্পর্কে আলেমদের রায় হলো:

إسناده حسن في المتابعات والشواهد رجاله ثقات وصدوقيين عدا سوار بن داود المزني

“এর সনদ মুতাবিয়াত (অনুসৃত সূত্র) ও শাওয়াহিদ (সহায়ক সূত্র) অনুযায়ী হাসান। বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী তবে সিওয়ার বিন দাউদ আল-মুজানি ছাড়া।

আমাদের গবেষণামতে কেউ যদি এই হাদিসের সনদগুলোর দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে, তাহলে এর মধ্যে সমস্যা দেখতে পাবে। নিচে তা তুলে ধরা হলো:

প্রথমত: এই হাদিসগুলোর সনদে বর্ণনাকারী হিসেবে সাওয়ার বিন দাউদ উপস্থিত রয়েছেন। তার সম্পর্কে আমাদের রিজাল শাস্ত্রবিদদের মতামত হলো: তার মারফতে বর্ণিত হাদিসগুলো দুর্বল। যেমন, হাফিজ যাহাবি (রহ.) তাকে দুর্বল বলেছেন। জারাহ ও তাদিলশাস্ত্র তথা বর্ণনাকারীদের সমালোচনা শাস্ত্রবিদগণ এই হাদিসের সনদের বিদ্যমান বর্ণানাকারী ‘সাওয়ার বিন দাউদ’ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। হাফিজ যাহাবি তাকে দুর্বল বলে মনে করেন। একইভাবে ‘তাকরিব আত-তাহযিব’ গ্রন্থের লেখকের অভিমত হলো ইবনে সাওয়ার নির্ভরযোগ্য নয়।

তিনি বলেন: ضعيف يعتبر به ، ولم يحسن الرأي فيه سوى أحمد

“তাকে দুর্বল বলে মনে করা হয় এবং শুধুমাত্র আহমদ তার সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখেন।”

অতএব, এই বর্ণনার ভিত্তিতে আবদুল্লাহ ইবনে আমরের মারফতে বর্ণিত বর্ণনাকে দুর্বল বলে গণ্য করা যেতে পারে। এই কারণে অনেক সমসাময়িক আলেম এই হাদিসকে এর সনদের প্রেক্ষিতে সহিহ মনে করেন না।

দ্বিতীয়ত: যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়, তা হলো আমর বিন শুয়াইব কী তার দাদার কথা পিতার মাধ্যমে বর্ণনা করছেন নাকী তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করছেন, এই বিষয়ে কোনো নিশ্চিয়তা পাওয়া যায় না। অতএব, যদি আগেরটা হয় তবে বর্ণনাটি সহিহ হবে এবং যদি পরেরটা হয় তবে সনদে বিচ্ছিন্নতা থাকবে।

তৃতীয়ত: ইবনে আবি শায়বা (রহ.)-এর রচিত গ্রন্থ মুসান্নাফে এই বর্ণনাটি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। সেখানে ইবনে আবি শায়বাহ এটাকে তাবেয়ির বক্তব্য হিসেবে পৃথকভাবে বর্ণনা করেছেন। এটা থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, এই বর্ণনাটি প্রকৃতপক্ষে কোনো হাদিসই নয়, বরং এটা একজন তাবেয়ির বক্তব্য। এই মর্মে বর্ণনাকারীর বক্তব্য হিসেবে উল্লিখিত রয়েছে:

حدثنا وكيع، عن سفيان، عن أبي رجاء، عن مكحول، قال: ”يؤمر الصبي بها إذا بلغ السبع ويضرب عليها إذا بلغ عشرا

ওয়াকি বর্ণনা করেন, সুফিয়ান থেকে শুনেছেন, তিনি আবি রাজা থেকে এবং তিনি মাকহুল থেকে শুনেছেন, তিনি বলেছেন, “যখন আপনার সন্তানের বয়স ৭ বছর হবে, তখন তাদের নামায পড়ার নির্দেশ দেন এবং যখন তারা ১০ বছর বয়সে পৌঁছাবে, তখন প্রহার করুন যদি তারা নামায না পড়ে।’’ (মুসান্নাফ আবি শায়বা, ৩৪০২)

তাই মারফু বর্ণনায় সনদের দুর্বলতা ও পূর্বোক্ত ত্রুটি উভয়ের ভিত্তিতে এই বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই বর্ণনাটি সাহাবির বক্তব্য অথবা তাবিযির গবেষণা ছিলো, যা পর্যায়ক্রমে হাদিসের মতো করে বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে বাযযারের একটি বর্ণনা দ্বারা এটা আরও নিশ্চিত হয়।

হাদিসের মহান পণ্ডিত ইমাম শওকানি তার নায়লুল আওতারে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, অন্য একটি বর্ণনা থেকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয় এই বর্ণনাটি একটা কাগজের টুকরোতে লেখা অবস্থায় রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে পাওয়া যায় এবং রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সম্বন্ধিত ছিলো না। বরং এটা ছিল এমন ব্যক্তির কথা, যার পরিচয় জানা যায়নি, যিনি বলেছিলেন শিশুকে ৯ বছর বয়সে নামাজ না পড়ার জন্য আঘাত করা যাবে। বর্ণনায় লেখা আছে:

আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাফি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আল্লাহর রাসুল (সা)-এর ইন্তেকালের পর আমরা একটি তরবারির কাছে লিখিত কাগজ পেলাম। যার উপর লেখা ছিল: ‘আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময় অশেষ দয়ালু। ভাই-বোনদের বিছানা আলাদা করো, যখন তারা ৭ বছর বয়সী হবে এবং আমি মনে করি ৯ বছর বয়সে নামাজ না পড়ার জন্য তাদের প্রহার করতে পারো।’

সারসংক্ষেপ

এই হাদিসের ভিত্তিতে কিছু আলেম শিক্ষার্থীদের মারধর করাকে বৈধ মনে করেন। তবে আমাদের মতামত হলো, এই বর্ণনাটি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে এসেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং এটা দুর্বল। এই কারণেই ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম এই বর্ণনা তাদের গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেননি। অধিকন্তু, এই বর্ণনার সনদের অসঙ্গতির আলোকে এই বর্ণনাকে প্রতিষ্ঠিত যুক্তি, বিবেক ও ইসলামের সম্মিলিত বাণীর বিরোধী মনে হয়। যেহেতু একজন ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরই কেবল নামাজ পড়তে বাধ্য, সেহেতু একটি শিশু যখন নামাজ পড়তে বাধ্য নয়, তাই তাকে নামাজ না পড়ার জন্য শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই।

মনোবিজ্ঞানীদের মতামত হলো, শৈশবকালে এই ধরনের কঠোরতা একজন ব্যক্তির আবেগ ও ধর্মের সাথে তার সংযোগকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

অন্যদিকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন একজন উদারমনা ব্যক্তি, যিনি সারাজীবন ধর্মের শিক্ষা দিয়েছিলেন স্নিগ্ধতা, ভদ্রতা ও যুক্তি সহকারে। এমন একজন মানুষ কীভাবে হঠাৎ এই দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, যার ফলস্বরূপ পিটাপিটি, মানসিক চাপ দিয়ে নামাজের মতো একটি পবিত্র কাজকে শারিরীকভাবে জোর করে করানোর পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে?

লেখক: মুহাম্মদ হাসান ইলিয়াস (ইসলামিক গবেষক এবং হাদিসবিশারদ)

অনুবাদ: ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ সাইফুদ্দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *