ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায় সময় দেখা যায় রাসুল (স)-কে অবমাননা করে নাস্তিক অথবা ইসলাম বিদ্বেষীরা বিভিন্ন বক্তব্য, কুরুচিপূর্ণ কার্টুন অংকন করে তা প্রচার করছে। শুধু বর্তমান সময় নয়, বহু আগে থেকেই ইসলাম বিদ্বেষীরা দ্বীন এবং রাসুল (স)-কে অপবাদ, অবমাননা, কটাক্ষ করে বই লিখেছে, ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছে। এমনকি রাসুল (স) জীবিত থাকা অবস্থায় তার শত্রুরা তাকে গালমন্দ করেছে, তার বিরুদ্ধে মিথ্যে তথ্য ছড়িয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে মুসলিম হিসেবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। রসুল (স) এর প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা রয়েছে, যা আমাদের জীবনের থেকেও বেশি; সেই ভালোবাসার ফুলের বাগানে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিঃসন্দেহে কোনো ধর্ম অথবা সেই ধর্মের মহামানবদের কটাক্ষ করা, তাদের ব্যঙ্গচিত্র আঁকা, তাদের নামে মিথ্যে তথ্য ছড়ানো ইত্যাদি অবমাননামূলক কাজ গুরুতর অপরাধ। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়। কেউ যদি এগুলোর উপর আক্রমণ করে তাহলে সেটি গুরুতর অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। একজন সাধারন মানুষের সম্মান রক্ষা করাও যেখানে রাষ্ট্রের কর্তব্য, সেখানে কোনো পয়গম্বর অথবা ধর্মীয় মহামানবদের অবমাননা করা আরো গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্র যদি অবমাননাকারীকে অতিদ্রুত শাস্তির আওতায় না আনে তাহলে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হতে বাধ্য। এটি সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে। এসব দিক বিবেচনা করলে ধর্ম ও নবী-রসূলদের অবমাননাকারীদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কঠিন আইন প্রণয়ন করা অপরিহার্য।
আমরা প্রায়শই দেখে থাকি ধর্ম অবমাননাকে বাক স্বাধীনতা হিসেবে প্রচার করা হয়! অথচ অশ্লীলতা / গালাগালি কখনোই বাকস্বাধীনতা হতে পারে না। আইনের শিথিলতা এবং রাষ্ট্রের অবহেলা এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে এক ধরনের নীরব সমর্থন যোগায়। যাইহোক, রাষ্ট্রের উচিত ধর্ম এবং পয়গম্বরদের যারা অবমাননা করে তাদের কঠোর হস্তে দমন করা। তবে এই শাস্তি সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা বিদ্যমান।
মুসলিমরা মনে করে কেউ যদি রাসুল (স)-কে অবমাননা করে তাহলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এর সপক্ষে তারা একটি হাদিস দলিল হিসেবে পেশ করে থাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এই হাদিসটি যঈফ (দুর্বল) এবং এর মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কখনোই কার্যকর করা সম্ভব নয়। আজকের আলোচনায় আমরা দেখার চেষ্টা করব কী কারণে এই হাদিসটি যঈফ এবং এর মাধ্যমে কেন রাসুল (স) এর অবমাননাকারীকে কখনোই মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়া যাবে না।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে মূল হাদিসটি এক নজর দেখে নেয়া যাক:
دَّثَنَا عُبَيْدُ اللهِ بْنُ مُحَمَّدٍ الْعُمَرِيُّ الْقَاضِي، قَالَ: نَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ أَبِي أُوَيْسٍ، قَالَ: حَدَّثَنِي مُوسَى بْنُ جَعْفَرِ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَبِيهِ جَعْفَرٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنْ حُسَيْنِ بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ أَبِيهِ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: ”مَنْ شَتَمَ الأَنْبِيَاءَ قُتِلَ، وَمَنْ شَتَمَ أَصْحَابِي جُلِدَ.
(المعجم الکبیر،رقم ۲۳۵)
অর্থ: ওবায়দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ওমর কাজী বর্ণনা করেছেন, ইসমাইল বিন আয়াইশ বলেছেন, মুসা ইবনে জাফর তার বাবা থেকে এবং তিনি তার দাদা থেকে এবং তিনি হাসান ইবনে আলী (রা) থেকে এবং হাসান (রা) তার পিতা আলী ইবনে আবু তালেব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুল (স) বলেছেন কেউ যদি কোনো নবী (আঃ)-কে গালমন্দ করে তাহলে তাকে হত্যা করা হবে এবং কেউ যদি আমার কোনো সাহাবী(রা)-কে গালি দেয় তাহলে তাকে চাবুক পেটা করা হবে।
এই হাদিসটি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখে নেয়া যাক:
১. প্রথমত এই হাদিসটি গোটা হাদিস শাস্ত্রে কেবলমাত্র হযরত আলী (রা) এর নিকট থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো হযরত আলী (রা) এর মৃত্যুর ৩০০ বছর পর সর্বপ্রথম এই হাদিসটি ইমাম তাবরানী (রহ) এর গ্রন্থ “ المعجم الصغیر’’ এর মধ্যে উল্লেখ করা হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই, যদি এই হাদিসটি নির্ভরযোগ্যই হতো তাহলে ইমাম তাবরানী (রহ) এর পূর্বেই অন্যান্য হাদিস গ্রন্থের মধ্যে হাদিসটি উল্লেখ থাকতো। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে সকল হাদিস ইমাম তাবরানী (রহ) এর প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে সংকলিত হয়েছিল যেমন: مسند طیالسی،مصنف عبد الرزاق اور مصنف ابن ابی شیبہ ইত্যাদি হাদিসের প্রাচীনতম এই গ্রন্থ গুলোর মধ্যে এ ধরনের কোনো হাদিস বর্ণিত নেই। অথচ এ সকল হাদিস গ্রন্থের মধ্যে হযরত আলী (রা) থেকে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
২. দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই হাদিসটি হাদিসের নির্ভরযোগ্য কোনো বড় গ্রন্থ যেমন; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, মুসনাদে আহমেদ, সহিহ তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, সহিহ নাসাই ইত্যাদির মধ্যে উল্লেখ করা হয়নি।
৩. আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই হাদিসটিকে দুর্বল প্রমাণ করে। যদি রাসূল (স) ইসলামের বিধান হিসেবে এমন কোনো কথা সত্যিই বলতেন তাহলে অন্য কোনো সাহাবী কেন এই হাদিসটি বর্ণনা করেননি? এটি এ হাদিসটিকে দুর্বল সাব্যস্ত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
এবার আমরা এই হাদিসটির সনদ সম্পর্কে আলোচনা করব:
ইমাম তাবরানী (রহ) এর গ্রন্থে উল্লেখিত এই হাদিস সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মতামত হলো এই হাদিসটি যঈফ। উল্লেখ করা হয়েছে:
ضعیف: إسناد فيه متهم بالوضع وهو عبيد الله بن محمد العمري وهو متهم بالكذب.
অর্থ: এই হাদিসটি যঈফ, কেননা এর বর্ণনাকারী ‘ওবায়দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ওমর কাজী’ যিনি নিজে থেকে বানিয়ে হাদিস বর্ণনা করা এবং মিথ্যা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত।
মুহাদ্দিসরা এই বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেছেন, তিনি শুধু মিথ্যা কথাই বলতেন না, বরং নিজ থেকে বানিয়ে হাদিস বর্ণনা করতেন। দারকুতনীর মতে এই বর্ণনাকারী দুর্বল।
ইমাম তাবরানী (রহ) এর পরে এই হাদিসটি ইমাম রাজি (রহ) এর ‘ فوائد تمام ’ গ্রন্থের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। রাজি (রহ) এর গ্রন্থে বর্ণিত হাদিসটির বর্ণনাকারী ইমাম তাবরানী (রহ) এর বর্ণনাকারী থেকে ভিন্ন হলেও সাহাবী হিসেবে এখানে হযরত আলী (রা) রয়েছেন। হাদিসটির আরবি ইবারত নিচে দেয়া হলো।
حَدَّثَنِي عَبْدُ السَّلامِ بْنُ صَالِحٍ الْهَرَوِيُّ، حَدَّثَنِي عَلِيُّ بْنُ مُوسَى الرِّضَا، حَدَّثَنِي أَبِي مُوسَى بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ أَبِيهِ جَعْفَرِ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَبِيهِ مُحَمَّدِ بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ أَبِيهِ عَلِيِّ بْنِ الْحُسَيْنِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَلِيٍّ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: ”مَنْ سَبَّ نَبِيًّا مِنَ الأَنْبِيَاءِ فَاقْتُلُوهُ، وَمَنْ سَبَّ وَاحِدًا مِنْ أَصْحَابِي فَاجْلِدُوهُ ‘‘.
রাজি (রহ) এর গ্রন্থে বর্ণিত হাদিসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মতামত হলো এই হাদিসটি যঈফ। উল্লেখ করা হয়েছে:
إسناد فيه متهم بالوضع وهو الحسين بن حميد الخزاز وهو متهم بالكذب.
অর্থ: এই হাদিসের সনদের মধ্যে হুসাইন ইবনে হামিদ রয়েছে, যিনি মিথ্যাবাদী এবং মনগড়া হাদিস রচনাকারী।
উক্ত বর্ণনাকারীর পূর্ণ নাম আল-হুসাইন বিন হামিদ আল-খাজাজ। আল-খাজাজ সম্পর্কে এ মতামত প্রসিদ্ধ যে, তিনি একজন মিথ্যাবাদী এবং মনগড়া হাদিস বর্ণনাকারী। আল-খাজাজ সম্পর্কে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ মুতিন আল-হাজরামি (রহ) বলেন যে তিনি “ ‘ كذاب بن كذاب بن كذاب ” অর্থ: সে মিথ্যাবাদী, তার পিতাও মিথ্যাবাদী এবং তার দাদাও মিথ্যাবাদী।
পরবর্তীতে এই একই হাদিস হযরত আলি (রা) এর মৃত্যুর প্রায় ৫০০ বছর পর কাজী আয়াজ মালিকী (রহ) নামক এক হাদিস বিশারদ তার গ্রন্থ “ الشفا بتعریف حقوق المصطفٰی ” এর মধ্যে হযরত আলী (রা) এর বর্ণনায় ভিন্ন সনদে সংকলন করেছেন। হাদিসটির আরবি ইবারাত নিচে দেয়া হলো।
عَنْ الشَّيْخِ أَبِي ذَرٍّ الْهَرَوِيِّ إِجَازَةً، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو الْحَسَنِ الدَّارَقُطْنِيُّ، وَأَبُو عُمَرَ بْنُ حَيَّوَيْهِ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ نُوحٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ الْحَسَنِ بْنِ زَبَالَةَ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ مُوسَى، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَلِيِّ بْنِ الْحُسَيْنِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ الْحُسَيْنِ بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ: ”مَنْ سَبَّ نَبِيًّا فَاقْتُلُوهُ، وَمَن سَبَّ أَصْحَابِي فَاضْرِبُوهُ‘‘.
যদিও কাজী আয়াজ মালিকী (রহ) এর গ্রন্থ নির্ভরযোগ্য কোনো হাদিস গ্রন্থ নয়। এরপরেও তার সংকলিত হাদিস সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মতামত হলো এটিও একটি যঈফ হাদিস।
উল্লেখ করা হয়েছে:
إسناد ضعيف، فيه عبد العزيز بن الحسن المدني، وهو ضعيف الحديث.
অর্থ: এই হাদিসটির সনদ যঈফ, এর কারণ হলো এই হাদিসের সনদে বর্ণনাকারী হিসেবে আব্দুল আজিজ বিন হাসান মাদানী উপস্থিত রয়েছেন যিনি সনদে অত্যন্ত দুর্বল।
প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আবু হাতেম ইবনে হিব্বান (রহ) উক্ত বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেন,
يأتي عن المدنيين بالمعضلات فبطل الاحتجاج به.
অর্থ: সে মাদানিদের থেকে জটিল বর্ণনা নিয়ে আসে। তার বর্ণনা থেকে দলিল পেশ করা বৈধ নয়।
উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় এ হাদিসটি সনদ এবং মতন উভয় দিক থেকেই দুর্বল এবং অগ্রহণযোগ্য। মূলত এই কারণেই হাদিসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ গুলোর মধ্যে এ হাদিসটি বর্ণনা করা হয়নি। এ ধরনের অগ্রহনযোগ্য দুর্বল হাদিসের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের মতো সর্বোচ্চ শাস্তির আইন কার্যকর করা কোনো ভাবেই ইসলাম সম্মত নয়। এছাড়াও রাসূল (স) এর নামে মিথ্যে হাদিস বর্ণনা করার শাস্তি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত আছি, যিনি রাসুল (স) এর নামে মিথ্যে হাদিস বর্ণনা করবে সে তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিবে।
লেখক: শাইথ উমর ফারুক
তথ্যসূত্র: এই প্রবন্ধটি আল মাওরিদের হাদিস গবেষণা প্রকল্প থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
Leave a Reply