ইসলামী শরীয়তে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পদ্ধতি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাতে কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার স্ত্রীর ইদ্দতকালকে আমলে না নিয়ে তালাক দেয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। একইভাবে রাগের বসে মুখে ‘তালাক-তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করে, কিংবা কোনো সাক্ষী না রেখে তালাক দিয়ে দেয়াও জায়েজ নেই। আবার স্ত্রীর ঋতুস্রাব চলা অবস্থায় তার সামনে গিয়ে তালাকের ফয়সালা শুনিয়ে দেয়া, অথবা একই সময়ে দু-তিনবার তালাক মুখে বলে দেয়া বা চিঠিতে লিখে দেয়া; এই সমস্ত তালাকের পদ্ধতি ইসলামী শরীয়তে অপছন্দনীয় বিষয়। এই পদ্ধতিতে কারো তালাক দেবার অধিকার নেই। রাসুল (স)-এর জীবদ্দশাতে এমন কাজ কেউ করলে তিনি অত্যন্ত রাগ করতেন।
এই মর্মে একটি হাদিস রয়েছে, এ রকমই একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন,
“যেখানে আমি রাসুল তোমাদের মাঝে উপস্থিত আছি, সেখানে আল্লাহর হুকুমকে নিয়ে এ কেমন খেল-তামাশা হচ্ছে?।” (নাসাঈ -৩৪৩০)
আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছে যে সমাজের ৯০ ভাগ মানুষ তালাক দিতে গিয়ে এই ভুল পদ্ধতি গুলো অনুসরণ করছে। গত ৩০ বছরে একজন সমাজ সচেতন ব্যক্তি হিসেবে আমি যতগুলো তালাকের ঘটনা সামনে পেয়েছি, তার দুই-একটা বাদে সবগুলোর ক্ষেত্রে একই ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। এটা বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ মনে প্রশ্ন আসতে পারে মানুষ জেনে-বুঝে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধ আচরণ করছেন? তারা কি হালাল ও হারামের তোয়াক্কা করা ছেড়ে দিয়েছেন? তাদের মন থেকে কি আল্লাহর ভয়-ডর সব উঠে গিয়েছে? তাদের মনে কি এই অনুভূতিটুকুও নেই যে একদিন আল্লাহর দরবারে এর জবাবদিহি করতে হবে?
আমার মতে এগুলোর কোনোটাই হচ্ছে না। লোকজন এসব ভুল আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে করছে না, বরং সম্পূর্ণ অজ্ঞতাবশতই তারা এগুলো করছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ এটা জানেনই না যে এ কাজগুলো করা শরীয়তে নিষেধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, ওলামাগন, এই অপরাধগুলার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন তো করছেই না, উল্টো এভাবে যে তালাকগুলো দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে সেগুলো তাঁরা কার্যকর বলে রায় দিচ্ছেন। তৃতীয়তঃ কেউ যদি তালাকনামা লেখার জন্য কোনো নোটারি করতে যায় বা কোনো বিবাহ রেজিস্ট্রি অফিসে যায় কিংবা কোনো আইনজীবী নিয়োগ করে, তারাও তাকে পদ্ধতিগত নিয়মাবলি উপেক্ষা করে সরাসরি তিন তালাক লেখা কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে। এ কাজটি এতটাই সাধারণ হয়ে গিয়েছে, কদাচিৎ হয়তো আপনি এমন কাউকে পাবেন যে আল্লাহর দেয়া শরীয়ত ও এর আদাব রক্ষা করে তালাক দিয়েছেন। এর পরিণতি বড়ই মর্মান্তিক!
এতে আল্লাহতায়ালার হুকুমের পেছনে মানুষকে সংশোধনের যে উদ্দেশ্য ছিলো তার সবটাই বরবাদ হয়ে যায়। আপোষ-মীমাংসা কিংবা ঘর বাঁচানোর সব সুযোগ নিঃশেষ হয়ে যায়। বাচ্চা, বুড়ো বা বন্ধু-বান্ধবদের কারো পক্ষে মিটমাট করে দেয়ার কোনো সুযোগ বাকি থাকে না। পরিবারে-পরিবারে স্থায়ী ঝগড়া বিবাদের শিকড় গেড়ে বসে। মানুষ যখন নিজের এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য ওলামাদের শরণাপন্ন হয়, তখন তারা হিল্লা বিয়ে করার পরামর্শ দেয়।
অথচ, হিল্লা বিয়ে করার ব্যাপারে রাসূল (স) এরশাদ করেছেন,
“যে তা ( হিল্লা বিয়ে) করে ও যে তা করায় উভয়ের উপর আল্লাহর লানত।” (ইবনে মাজাহ ১৯৩৬)
এভাবে মাত্র কয়েকটি শব্দ মুখ দিয়ে বের করার কাফফারা হিসাবে সারা জীবন পস্তাতে হয়। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গুলো নেয়া আবশ্যক:
১. আলিমগণ তাদের জুমার খুতবায়, ওয়াজ নসিহতে এবং তালিম ও তরবিয়তের সকল মজলিশে মানুষকে এই ভুলগুলোর ব্যাপারে সচেতন করবেন। এ ব্যাপারে রাসূল (স)-এর হাদিসগুলো বিস্তারিত ও সার্বজনীনভাবে পেশ করবেন এবং সে অনুযায়ী লোকজনকে বোঝাতে থাকবেন যে, কেবল এক তালাক দেয়া যাবে। ঠান্ডা মেজাজে বুঝে-শুনে দুইজন স্বাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করে, ইদ্দতের হিসাব আর ঋতুস্রাব চলাকালীন সময় শেষ করে, তারপর তালাক দেবে। এমন ভাবে তালাক দেবে যাতে স্ত্রীকে জনসম্মুখে আলোচনা আর হাস্যরসের বস্তুতে পরিণত হতে না হয়।
২. কাবিন নামার মতো করে কাজী অফিসগুলোতে একটা লিখিত তালাক নামার ফর্ম সরকারীভাবে সরবরাহ করা হোক। নিয়ম করা হোক, কেউ তালাক দিতে চাইলে কেবল এই তালাকনামা পড়েই তা দিতে পারবে। এর বাইরে তালাক দেয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।
৩. ভুল পদ্ধতিতে তালাক কার্যকর না করে, ওলামা, ফকীহ ও পারিবারিক আদালতের উচিত, এ ধরনের বিষয়ে রাসুল (স)-এর অনুসৃত পদ্ধতিগুলো চালু করা। হাদিসের গ্রন্থের মধ্যে এ সম্পর্কে দুটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম ঘটনা:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদি)-কে নিয়ে। তিনি তার স্ত্রীর ঋতুস্রাব চলা অবস্থায় তাকে তালাক দিয়ে ফেললে, পরে ওমর (রাদি) ব্যাপারটা রাসুল (স)-কে জানালেন। তিনি ঘটনাটা শুনে প্রচন্ড রাগ করলেন আর বললেন, তাকে আদেশ দাও যাতে সে (তালাক) বাতিল করে। তারপর স্ত্রী-সঙ্গ বন্ধ রাখে, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ ঋতুস্রাব শেষ হয়ে পরের ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং সেই ঋতুস্রাব থেকেও পাক-পবিত্র হয়। এরমাঝে চাইলে তারা মিল হয়ে যাক অথবা পুনরায় দেখা করার আগেই (আবার) তালাক দেয়া হোক। কারণ এটাই হলো ইদ্দতের শুরু, যা হিসাবে রেখে আল্লাহতায়ালা নারীকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী ৫২৫১, মুসলিম ৩৬৫৭)
দ্বিতীয় ঘটনা:
দ্বিতীয় ঘটনাটি রুকানা ইবনে আবদে ইয়াজিদকে নিয়ে। এ সম্পর্কে সব হাদিস জমা করলে যে ঘটনা সামনে আসে তা হলো, তিনি তার স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিয়ে দিলেন। কিন্তু পরে অনুতপ্ত হলেন এবং বিষয়টি রাসুল (স)-এর কাছে পেশ করলেন। রাসুল (স) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তালাক কিভাবে দিয়েছ?” তিনি জবাব দিলেন, বিবিকে একত্রে তিন তালাক দিয়ে বসেছি। রাসুল (স) বললেন, “মনের ইচ্ছাটা কি ছিলো?” তিনি জবাবে বললেন, মনের উদ্দেশ্য তো ছিলো এক তালাক দেয়া। রাসুল (স) কসম দিয়ে প্রশ্ন করলে তিনিও কসম করে বললেন। নবী (স) বললেন, “এই যখন ব্যাপার, তাহলে তালাক ফিরিয়ে নাও।” এটা একটাই তালাক হয়েছে। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, কিন্তু আমি যে তিন তালাক উচ্চারণ করে ফেলেছি? রাসুল (স) জবাব দিলেন, “আমি জানি।” কিন্তু ফিরিয়ে নাও। তালাক দেয়ার সঠিক পদ্ধতি এটা নয়। আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, নারীদেরকে তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে ইদ্দত হিসাব করে দাও।”
(আবু দাউদ ২১৯৬ , ২২০৬, ইবনে মাজাহ, ২০৫১, তিরমিযী ১১৭৭,আহমেদ ২৩৮৩)
প্রবন্ধটি উস্তাদ জাভেদ আহমদ গামিদির মাকামত বই থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।
অনুবাদক: ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন
Leave a Reply