দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের মধ্যে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তারা মনে করে গাজওয়াতুল হিন্দ দ্বীন-ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, রাসুল (স) এ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন এবং এটি ঘটবে। এর ফলে যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মুসলিমরা গাজওয়াতুল হিন্দের আলোচনা টেনে আনে। এ পর্যায়ে আমরা দেখার চেষ্টা করব হাদিসের মধ্যে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা কতটুকু সত্য।
গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে ইমাম নাসাঈ তার ‘সুনানে’ এবং আহমদ ইবনে হাম্বল তার ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে দুটি হাদিস খুবই প্রসিদ্ধ এবং এই হাদিস দুটির বর্ণনাকারীদের ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি ন্যারেটিভ হয়েছে।
প্রথম হাদিস:
রাসুল (স) বলেছেন, আমার উম্মতের দুটি জামাআত আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন। একটি জামাআত যারা হিন্দু্স্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করবে আর অপর জামাআত যারা ঈসা ইবনে মারইয়ামের সাথে থাকবে।
এই হাদিসটি সামান্য পরিবর্তনের সাথে দুটি হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। নিচে দুটি গ্রন্থ থেকে বর্ণনাকারীদের চেইন উল্লেখ করা হলো।
১. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল রহিম, আসাদ ইবনে মুসা, বাকিয়া, আবু বকর আল জুবাইদি, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, লুকমান ইবনে আমির, আব্দুল্লাহ ইবনে আদি আল বাহরানী, রাসুল (স)। (সুনানে নাসাঈ)
২.আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে হাম্বল, আহমদ ইবনে হাম্বল, আবু নাজার, বাকিয়াহ, আবদুল্লাহ ইবনে সালিম, আবু বকর ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, লুকমান ইবনে আমির আল ওয়াসাবি, আবদুল আলা ইবনে আদি আল বাহরানী, রাসুল (স)। (মুসনাদে আহমদ)
দ্বিতীয় হাদিস:
মহানবী (স) আমাদেরকে ‘আল-হিন্দ’ যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এইভাবে যদি এটি আমার জীবদ্দশায় ঘটে, তবে আমি আমার জীবন এবং এতে আমার সমস্ত জিনিসপত্র বিলিয়ে দেবো। যদি আমি এতে নিহত হই তবে আমি (ইসলামের) শ্রেষ্ঠ শহীদ হব এবং যদি আমি (জীবিত) ফিরে যাই তবে আমি মুক্ত আবু হুরায়রাহ হয়ে যাব! (অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত)।
এই হাদিসটি সামান্য পরিবর্তনের সাথে দুটি হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। নিচে দুটি গ্রন্থ থেকে বর্ণনাকারীদের চেইন উল্লেখ হলো।
১. আহমাদ ইবনে উসমান ইবনে হাকিম, জাকারিয়া ইবনে আদি, উবাইদুল্লাহ ইবনে আমর, জায়েদ ইবনে আবি উনাইসাহ, জাবির ইবনে আবেদাহ, আবু হুরায়রা (রা)। (সুনানে নাসাঈ)
২.আহমাদ ইবনে উসমান ইবনে হাকিম, জাকারিয়া ইবনে আদি, হুশাইম, সাইয়ার, জাবির ইবনে আবেদা, আবু হুরায়রা (রা)। (সুনানে নাসাঈ)
৩.মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম, ইয়াজিদ, হুশাইম, সাইয়ার, জাবির ইবনে আবেদাহ, আবু হুরায়রা (রা)। (সুনানে নাসাঈ)
৪.আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে হাম্বল, আহমদ ইবনে হাম্বল, হুশাইম, ইয়াসার, জাবির ইবনে আবেদা, আবু হুরায়রা (রা)। (মুসনাদে আহমদ)
এবার আমরা হাদিস দুটির বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে দেখব। উল্লেখ্য যে, ইসলাম সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে নিতে হবে। যেহেতু কুরআন এবং সুন্নাহর মধ্যে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি; সুতরাং আমরা হাদিস গবেষণার মূলনীতি অনুযায়ী উপরে উল্লেখিত হাদিস দুটি যাচাই করব।
প্রথম হাদিসের বর্ণনাকারীগণ:
প্রথম চেইন
১.আসাদ ইবনে মুসা
আসাদ ইবনে মুসার পুরো নাম আসাদ ইবনে মুসা ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ইবনে আল হাকাম। ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে আসাদ ইবনে মুসা সম্পর্কে কয়েকজন আলেমের (ইবনে ইউনুস, আবদুল হক) মতামত উল্লেখ করেছেন। ইবনে ইউনুস বলেন, আসাদ ইবনে মুসা বেশ কিছু মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাযমের মতে আসাদ ইবনে মুসা তার বর্ণনায় জঘন্য এবং দুর্বল বর্ণনাকারী। আবদুল হক বলেছেন, তিনি আসাদ ইবনে মুসার বর্ণনাকে যুক্তিযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।
২.বাকিয়াহ
আসাদ ইবনে মূসা এই হাদিসটি ‘বাকিয়াহ’ থেকে বর্ণনা করেছেন। বাকিয়াহর পুরো নাম বাকিয়াহ ইবনে আল-ওয়ালিদ ইবনে সাঈদ।
ইমাম যাহাবী তার গ্রন্থ ’মীজানুল ইতেদাল’ এ লিখেছেন, একাধিক ব্যক্তি বলেছেন বাকিয়াহ তার বর্ণনাগুলি এমন লোকদের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যাদের থেকে তিনি এই বর্ণনাগুলি শোনেননি। আবু হাতিম বলেন, বাকিয়ার বর্ণনাগুলোকে যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। আবু ইসহাক আল জুজানি বলেছেন, আল্লাহ বাকিয়ার উপর রহম করুন, তিনি কার কাছ থেকে এই ধরনের বর্ণনা নিচ্ছেন তা যাচাই করার পরোয়া না করেই তিনি মূল্যহীন বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে খুজাইমাহ বলেছেন, আমি বাকিয়ার বর্ণনাগুলোকে যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে করি না। আহমাদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত হয়েছে, আমি মনে করতাম যে বাকিয়াহ কেবল গ্রহণযোগ্য বর্ণনাগুলি অজানা লোকদের কাছে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারপর আমি দেখতে পেলাম তিনি (ভুলভাবে) অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাগুলিকে পরিচিত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছে বর্ণনা করেছেন।
হাফিজ আল মিযযী তার ‘তাহযীবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থে ইয়াহিয়া ইবনে মুঈনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, বাকিয়াহ উদ্ধৃত করার আগে দুর্বল এবং অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে একশত বর্ণনা বর্ণনা করতেন।
৩. আবু বকর আল জুবাইদি
তার পুরো নাম আবু বকর ইবনে আল ওয়ালিদ ইবনে আমির আল জুবাইদি। রাসুল (স)-এর বাণী বর্ণনা করেছেন এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহে তার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। সামান্য যা পাওয়া গেছে তা নির্ভরযোগ নয়। ইবনে হাজার তার ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেন, আবু বকর আল জুবাইদির জীবন ও চরিত্র জানা নেই।
হাফিজ আল মিযযী তার ‘তাহযীবুল-কামাল ফি আসমাইর-রিজাল; গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেন, শুধুমাত্র বাকিয়াহ আবু বকর আল জুবাইদির থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এটি একজন বর্ণনাকারী অবিশ্বস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৪. মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি
ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে আল খলিলিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদির বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে যদি সেগুলি একজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ হাদিসের অন্যান্য বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হলে তার বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হবে; আর তা না হলে মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদির বর্ণিত বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না।
৫. আব্দুল আলা ইবন আদি আল বাহরানী
আবদুল আলা ইবনে আদি আল বাহরানী সম্পর্কে মন্তব্যগুলি সাধারণত যথেষ্ট ইতিবাচক। কারণ তাকে একজন নির্ভরযোগ্য এবং সত্যবাদী ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ইবন আল কাত্তানের মতে, একজন বর্ণনাকারী হিসাবে তার অবস্থান সুপরিচিত নয়। এ কথাটি ইবনে হাজার তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
প্রথম হাদিসটির দ্বিতীয় চেইনের মধ্যে উপরে উল্লেখিত বর্ণনাকারীরা উপস্থিত রয়েছেন। যেমন বাকিয়াহ, আবু বকর ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি। সুতরাং এই ন্যারেটিভও গ্রহণযোগ্য নয়।
দ্বিতীয় হাদিস বর্ণনাকারীগণ:
প্রথম চেইন:
১.যাকারিয়া ইবনে আদি
জাকরিয়া ইবনে আদী সম্পর্কে হাদিস গবেষকগণ ইতিবাচক মতামত পোষণ করেছেন। তবে হাফিজ আল মিযযী তার ‘তাহযীবুল-কামাল ফি আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থে এবং হাফিজ ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নুয়াইম বলেছেন, যাকারিয়া ইবনে আদি হাদিস শাস্ত্রের থেকে তাওরাত শাস্ত্রে অনেক বেশি পারদর্শী ছিলেন।
২. উবায়েদুল্লাহ ইবনে আমর
উবায়েদুল্লাহ ইবনে আমর সম্পর্কে মন্তব্যগুলি সাধারণত বেশ ইতিবাচক। তবে ইমাম যাহাবী তার ‘তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে মোহাম্মদ ইবনে সাদের মতামত উল্লেখ করেছেন। ইবনে সাদ বলেছেন, যদিও উবায়েদুল্লাহ ইবনে আমর যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য, তবুও মাঝে মাঝে তিনি ভুল করেছেন। আবু ওয়াহাব আল আসাদির মতামত উল্লেখ করে ইবনে হাজার তার ‘তাকরীবুত-তাহযীব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আমর কখনও কখনও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন।
৩. জাবির ইবনে আবিদাহ
জাবিরের নাম কিছু ক্ষেত্রে জাবর ইবনে আবীদাহ বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম যাহাবি তার ‘মীজানুল-ইতেদাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, জাবির কে ছিলেন তা জানা যায়নি এবং হিন্দের (ভারত) যুদ্ধ সম্পর্কিত তার বর্ণনা অগ্রাহনযোগ্য এবং মিথ্যা। হাফিজ মিযযী তার ‘তাহযীবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, হিন্দের যুদ্ধের বর্ণনাটি একমাত্র জাবিরের দ্বারা বর্ণিত।
দ্বিতীয় চেইন:
১. হুশাইম
তার পুরো নাম হুশাইম ইবনে বুশাইর ইবনে আল কাসিম ইবনে দীনার আস সুলামি। হুশাইম সম্পর্কে ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে যে সকল কথা বর্ণনা করেছেন তা নিচে তুলে ধরা হলো:
ইবনে সাদ বলেন, হুশাইম অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি ভুলভাবে এমন লোকদের কাছে থেকে বর্ণনা করেছেন যাদের কাছ থেকে তিনি সেগুলো শুনেননি। আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, হুশাইম তার বর্ণনাগুলি এমন অনেক লোকের কাছে থেকে বর্ণনা করেছেন যাদের কাছ থেকে তিনি শোনেননি। হুশাইম সাইয়ারের কাছ থেকে হিন্দের যুদ্ধ সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছে। আহমদ ইবনে হাম্বলের মতে হুশাইমের বর্ণনার কোনো মূল্য নেই।
তৃতীয় এবং চতুর্থ চেইন:
তৃতীয় এবং চতুর্থ চেইনে হুশাইম ও সাইয়ার উপস্থিত রয়েছেন। এছাড়াও রয়েছেন জাবির ইবনে আবেদা। আর এ সকল বর্ণনাকারীদের অনির্ভরযোগ্য হওয়ার বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এছাড়াও চতুর্থ চেইনে সাইয়ার বানান ত্রুটির কারণে ইয়াসার হয়ে গিয়েছে।
এ সকল আলোচনার মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, উপরে উল্লেখিত দুটি হাদিসের বর্ণনাকারীদের ছয়টি চেইনের মধ্যে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর উপস্থিতি নেই। সুতরাং গাজওয়াতুল হিন্দের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে আমরা এই অনির্ভরযোগ্য হাদিসের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
আল মাওরিদ হিন্দের ইংলিশ আর্টিকেল থেকে প্রবন্ধটি অনুবাদ করা হয়েছে।
অনুবাদ: আল মানার ইনস্টিটিউট
Leave a Reply