কুকুর কি নাপাক প্রাণী? ইসলামের দৃষ্টিতে কুকুর পালন

Moderator Avatar

কুকুর পালন ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। মানুষ কুরআন মাজিদ মোটেও বুঝে পড়ে না। তাই এ ব্যাপারে জানে না। সূরা মায়েদায়  আল্লাহ বলেছেন তোমরা যে কুকুরদের শিকারের প্রশিক্ষণ দাও সেই জ্ঞান আমি তোমাদের দিয়েছি। আর তোমরা শিকারি কুকুরদেরকে আল্লাহর নাম নিয়ে শিকারে পাঠালে এবং তারা কোনো প্রাণী শিকার করে আনলে সেটা জবেহ করা ছাড়াই তোমাদের জন্য হালাল হবে।

তার মানে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে যদি কেউ তার কুকুরকে শিকারে পাঠায় আর সেই কুকুর যদি কামড়ে একটা প্রাণী শিকার করে আনে সেটা জবেহ করা ছাড়াই আমাদের জন্য খাওয়া হালাল হবে। এবার বলুন, কুকুর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তো তাকে পালতে হবে, তা না হলে কি আকাশ থেকে আপনাকে কেউ প্রশিক্ষণ দেওয়া কুকুর পাঠাবে? আর শিকারি কুকুর কিন্তু মুখ দিয়েই শিকার কামড়ে নিয়ে আসবে। তাই কুকুরকে নাপাক প্রাণী বলা মোটেও ঠিক নয়।

কুরআনে অনেক প্রসিদ্ধ একটি অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন আসহাবে কাহফের ব্যাপারে। আপনারা জানেন, আল্লাহ কীভাবে সেটা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “তুমি মনে করবে যে, তারা সজাগ, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত, আমি তাদের ডানে বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম। আর তাদের কুকুরটি ছিল গুহাদ্বারের সম্মুখে সামনের পা দুটি প্রসারিত করে।” সুতরাং কুকুরের ব্যাপারে দয়া করে খারাপ ধারণা পোষণ করা বন্ধ করুন। আল্লাহ বরং কুকুরের প্রশংসা করেছেন। কুকুরের আরবি হচ্ছে كلب (কালব) , আল্লাহ সূরা মায়েদার আয়াতে مُکَلِّبِیۡنَ (মুকাল্লেবিন) শব্দ ব্যবহার করেছেন।

অনেকে শিকারি কুকুর পালন বৈধ বলে আর বাসা-বাড়িতে কুকুর পালনকে হারাম বলে। এটা আরেকটি ভুল ধারণা। তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে আপনার কুকুরকে একটু পাহারা দিতে বলবেন, তাহলেই হবে। যাতে জায়েজ হয়ে যায়। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো হুকুম দিতে হলে সেটার ভিত্তি শক্তিশালী হতে হবে। কুরআন মাজিদ কুকুরের ব্যাপারে কত সুন্দরভাবে প্রশংসা করে আয়াত নাজিল করেছে। এমনকি আরবে প্রায় সবাই কুকুর পালন করত। ছাগল-ভেড়ার রক্ষণাবেক্ষণের  জন্য কুকুর পালন জরুরি ছিল। আর যেই কুকুর আপনি কাজে লাগাবেন সেটা স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে লালন পালন করতে হবে। সেই পালিত কুকুরকে আপনি আদর করবেন, ভালোবাসবেন, গোসল করাবেন, খাবার খাওয়াবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই কুকুর নাপাক বা গায়ে লাগলে অজু চলে যাবে, এমনটা ভাবা ভুল।

একটি হাদিস ভুলভাবে বুঝার কারণে এই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। হাদিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বর্ণনাকারী ঐ হাদিসের প্রেক্ষাপট, সময়, কারণ, আর কাকে কী উদ্দেশ্যে কথাটি বলা হয়েছিল, এগুলো-সহ বর্ণনা করে না। আর একারণে আলেমরাও শুধু হাদিসের মূল কথাটি শুনে ফতোয়া দিয়ে ফেলেন।

ইসলাম ধর্মে একটি ‘জীবন’কে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; সেটা মানুষের হোক বা প্রাণীর। তাই আল্লাহ বলেছেন নিরপরাধ একজন মানুষ হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা। ঠিক তেমনি বিনা প্রয়োজনে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা বা বেঁধে রাখাও হারাম করা হয়েছে। রাসুল (স.) বলেছেন, এক মহিলা বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল, তারপর বিড়ালটি মারা যায়, তাই সে জাহান্নামে যাবে।

একইভাবে আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুকুর বাঁধে, তার আমল থেকে প্রতিদিন এক ক্বীরাত্ব পরিমাণ কমে যায়।” (বুখারী ২৩২২, মুসলিম ৪১১৩-৪১১৮)

আপনার প্রয়োজনে আপনি যদি কোনো প্রাণীর গোশত খেতে চান তাহলে সৃষ্টিকর্তা কিছু শর্ত দিয়েছেন সেটা মেনে তাকে জবেহ করা যাবে। তা হচ্ছে আল্লাহর নাম নিয়ে পশুটি জবেহ করতে হবে এবং তার রক্ত প্রবাহিত করতে হবে। এই দুইটি শর্ত মেনে কোনো পশুকে জবেহ করা যাবে। কিন্তু সেটা গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে। তেমনি ক্ষতিকর কোনো প্রাণীকেও ক্ষতির আশঙ্কায় হত্যা করা যাবে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে শুধু শুধু একটি পিঁপড়াও হত্যা করা হারাম। সুতরাং কোনো কারণ ছাড়া কুকুর বা অন্যকোনো প্রাণীকে বেঁধে বা আটকে রাখা যাবে না।

.

প্রথমে এটা ঠিক করুন, আপনি কী উদ্দেশ্যে প্রাণীটাকে পুষতে চান? সেটা যেন কোনো পশুকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে না হয়। পশু পালনের ক্ষেত্রে তাকে পোষ মানানোর জন্য কয়েকদিন আটকে রাখতে হবে, এটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয় খাবার ও সকল প্রকারের প্রয়োজন আপনাকে মেটাতে হবে।

মদিনায় বাচ্চারা কুকুরকে শুধু শুধু বেঁধে রাখত আর এভাবে কষ্ট দিত। শহরেও দেখতে পাবেন, অনেক দুষ্টু ছেলে কুকুরকে এভাবে বেঁধে বা ইট মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রাসুল (স.) বলেছেন, কুকুরকে বিনা প্রয়োজনে এভাবে বেঁধে রেখে কষ্ট দেওয়া যাবে না। এমনটা করা উচিত নয়। “কুকুরকে বেঁধে রাখা নিষেধ” এই কথাকে “কুকুর পালন করা নিষেধ” মনে করে নিয়েছে মানুষ।

মনে করুন, আপনার ঘরে একজন মেহমান বেড়াতে আসলো। আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রত্যেকের নিজের কিছু পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকে। এভাবেই জিবরাইল (আ.) একদিন রাসুল (স.) এর কাছে এসেছিলেন আর ঐ অবস্থায় রাসুল (স.) এর খাটের নিচে একটি কুকুর ছিল। তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, “আপনার ঘরে কুকুর আছে, তাই আমি প্রবেশ করব না। যেই ঘরে কুকুর থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।” ব্যস এইটুকুই ছিল। উনার ব্যক্তিগত একটি অপছন্দের বিষয়। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে তাদের অপছন্দের বিষয় এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, এর বাইরে কিছুই নয়। এখানে আল্লাহ বা রাসুল (স.) কুকুরের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন না।

রহমতের ফেরেশতা কীভাবে ঘরে আসে আর কীভাবে রহমত নাজিল করে সেটা তো আল্লাহ ভালো জানেন। যদি এক্ষেত্রে কুকুরের সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় থাকত, তাহলে আল্লাহ কুরআন মাজিদেই বলে দিতেন বা রাসুল (স.) কুকুর পালন হারাম বলে দিতেন। কিন্তু এমন কিছুই কুরআন-হাদিসে নেই। বরং ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এই কথা বলেছেন। সেটা হতে পারে উনার ব্যক্তিগত অপছন্দের বিষয়। ফেরেশতাদের নিজস্ব একটি সেনসিটিভ বিষয় থাকতেই পারে। শিকারি কুকুরও তো পালন করাই লাগে। এর মানে তো এই না যে, সেখানে রহমত প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। বরং আল্লাহ তাদের ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন, যেমনটা উপরে বললাম।

অপবিত্রতার ব্যাপারে দ্বীন কিছু না বললেও স্বভাবগতভাবে আমরা সবাই জানি যে, অপবিত্র কিছু আমাদের জামা-কাপড়ে বা খাবারে লেগে গেলে সেটা পরিষ্কার করতে হয়। যেহেতু কুকুরের বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে, আর সেটা মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে এবং বেওয়ারিশ কুকুর অপবিত্র জায়গায় হাঁটাচলা করে, তাই রাসুল (স.) বলেছিলেন, কুকুর কোনো খাবারে মুখ দিলে সেটা ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ো। এই হাদিসটিও ভুলভাবে মানুষ গ্রহণ করেছে। এখানে অপবিত্রতার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষ কুকুরকে অপবিত্র মনে করে আর বিড়ালকে পবিত্র মনে করে। অথচ বেওয়ারিশ বিড়ালও বিভিন্ন গলিতে, ড্রেনে, ময়লায় হেঁটে বেড়ায় আর তাতে তদের পায়েও অপবিত্রতা লাগে। সেই বিড়াল ঘরে প্রবেশ করলেও কিন্তু অপবিত্র হয়। তাই খেয়াল রাখতে হবে, অপবিত্র আর নোংরা বস্তু থেকে যেন প্রাণীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়।

(উস্তাদ জাভেদ আহমেদ গামিদির লেকচারের আলোকে)

অনুবাদ: আরিফ আহমদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *