মাহরাম সাথে না থাকার কারণে কি নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়? মাহরামের সাথে সফরের বিষয়ে ইসলামে যা বলা হয়েছে

Moderator Avatar


নারীর সঙ্গে মাহরাম থাকা বা না থাকার সাথে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা বলছে মাহরাম সাথে না থাকার কারণে নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, তাদের এই কথা ধর্ষকের পক্ষে এক ধরনের নীরব সমর্থন জোগায়। ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের একটি নিউজে বলা হয়েছিল ‘‘স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ, ইউপি সদস্য গ্রেফতার।’’{১} এখানে নারীর সাথে তার সব থেকে আপন পুরুষ তার স্বামী উপস্থিত থাকার পরেও; সেই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অতএব আমাদের আলেমদের প্রথমে এ কথা বলা বন্ধ করতে হবে যে, নারীরা তাদের পোশাক, চলাফেরা এবং মাহরাম সাথে না থাকার কারণে ধর্ষণের শিকার হয়। কেননা এ ধরনের মন্তব্য নীরবে ধর্ষকের পক্ষে সমর্থন জোগায়।

এবার আসুন মাহরাম সাথে নিয়ে নারীদের সফর করার বিষয়ে ইসলামে কী বলা হয়েছে সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। প্রথমত কুরআনে এই হুকুম দেয়া হয়নি। তাই একথা স্পষ্ট যে, এটি শরীয়তের কোনো বিধান নয়। তবে বেশ কিছু প্রসিদ্ধ হাদিসে মাহরাম ব্যতীত নারীদের সফর করার বিষয়ে রাসুল (স) নিষেধ করেছেন। এই হাদিসগুলো যদি আমরা পড়ি তাহলে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারব; এই নিষেধাজ্ঞা পরিবেশ এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। এটি সর্বজনীন কোনো বিধান নয়। নিচে কিছু প্রসিদ্ধ হাদিসের সারমর্ম এবং সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ আমি তুলে ধরছি:

১. এই হাদিসটি সহিহ বুখারির ১০৮৮ নম্বর হাদিস। এখানে বলা হয়েছে, যে নারী আল্লাহ এবং পরকাল দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্য বৈধ নয় যে, তিনি কোনো মাহরাম ছাড়া এক দিন ও এক রাতের দূরত্বের ভ্রমণ করবেন।

এই হাদিসের প্রতিটি শব্দ আমাদেরকে স্পষ্ট করে বলে যে, এই হুকুম রাসূল (স) নারীদেরকে তৎকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দিয়েছিলেন। এখানে রাসুল (স) বলেছেন, ভ্রমণের ক্ষেত্রে এক দিন ও এক রাতের বেশি দূরত্ব মাহরাম ছাড়া অতিক্রম করা যাবে না। এটি যদি সর্বজনীন কোনো বিধান হতো তাহলে রাসূল (স) নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারণ করে দিতেন না। সরাসরি বলে দিতেন নারীরা মাহরাম ব্যতীত সফর করতে পারবে না।

২. সহিহ বুখারির ১০৮৬ নম্বর হাদিসে বলা হয়েছে, “কোনো নারী মাহরাম ছাড়া যেন তিন দিনের বেশি দূরত্বে ভ্রমণ না করে।’’

উপরের হাদিসে এক দিনের কথা বলা হলেও এই হাদিসে তিন দিনের কথা বলা হয়েছে। এখান থেকে আমরা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, এই হুকুমটি পরিবেশ এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল।

৩. আরো একটি প্রসিদ্ধ হাদিস যা সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “যে নারী আল্লাহ এবং পরকাল দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্য তিন দিন বা তার চেয়ে বেশি সময়ের ভ্রমণ করা বৈধ নয়, যতক্ষণ না তার সঙ্গে তার বাবা, ছেলে, স্বামী, ভাই বা কোনো মাহরাম আত্মীয় না থাকে।” (সহিহ মুসলিম: ৩২৭০)

উপরের হাদিস দুটিতে যে কথা বলা হয়েছিল এখানে সেই একই কথা বলা হয়েছে। পার্থক্য শুধু এই হাদিসে মাহরাম পুরুষের নামগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

৪. আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিস যা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে; সেখানে রাসূল (স) সরাসরি বলেছেন, وَلَا تُسَافِرَنَّ امْرَأَۃٌ إِلَّا وَمَعَہَا مَحْرَمٌ،  (এবং কোনো নারী মাহরাম ছাড়া কখনও ভ্রমণ করবে না)। হ্যাঁ, রাসূল (স) সরাসরি এ কথাই বলেছেন। তবে একটু থামুন, এই কথা বলার আগে তিনি বলেছেন, لَا یَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَۃٍ (কোনো পুরুষ এবং নারী কখনও একান্তে একসাথে অবস্থান করবে না)। এই কথা প্রথমে বলার পর রাসুল (স) বলেছেন, নারী মাহরাম ছাড়া কখনও ভ্রমণ করবে না। এরপর একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আমি অমুক-অমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য নাম লিখে রেখেছি, অথচ আমার স্ত্রী হজ করতে যাচ্ছে। রাসুল (স) বললেন, “তাহলে তুমি তার সাথে হজ করতে যাও।” (সহিহ বুখারি: ৩০০৬)

এই হাদিস থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি; গায়ের মাহরামের সাথে নারীরা যাতে ভ্রমণ না করে সেজন্য রাসূল (স) এই হুকুম দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে মানুষ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করত। পথের মধ্যে তারা তাঁবুতে অবস্থান করত। এই পরিস্থিতিতে গায়ের মাহরামের সাথে একজন নারীর ভ্রমণ করা মোটেও সমীচীন ছিল না। এজন্যই উক্ত সাহাবি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য নিজের নাম তালিকাভুক্ত করার পরেও; তার স্ত্রী যখন হজে যেতে চাচ্ছিলেন তখন রাসুল (স) ঐ ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর সাথে হজে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

মূল কথা হলো নারীরা সফরের সময় মাহরামকে সাথে রাখবে কি রাখবে না, সেটি নির্ভর করবে পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর। কোনো স্থানে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে যদি বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে অবশ্যই নারীরা মাহরাম সাথে নিয়ে ভ্রমণ করবেন। বর্তমান সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই উন্নত হয়েছে। প্লেনে অথবা গাড়িতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে একজন নারীর বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বর্তমানে হজের সময় নারীদের জন্য আলাদা তাবু এবং নারী হজ গাইড থাকে। সুতরাং নারী যদি নিরাপদ মনে করে তাহলে অবশ্যই মাহরাম ব্যতীত তিনি ভ্রমণ করতে এবং হজে যেতে পারেন।

নিরাপত্তার প্রশ্নটি নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান। রাত দুইটার সময় ঢাকার মোহাম্মদপুর দিয়ে কোনো পুরুষ মানুষ একা হেঁটে যাওয়ার সাহস করবে না। কারণ বর্তমানে ছিনতাই খুবই বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু আইনের মাধ্যমে ছিনতাই দমন করার পরিবর্তে আমরা যদি বলি এখন থেকে পুরুষরাও নিজেদের সাথে দুজন বডিগার্ড নিয়ে মোহাম্মদপুর দিয়ে যাতায়াত করবে; তাহলে এটা হবে সবথেকে বড় বোকামি। ঠিক তেমনিভাবে, ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে; আমরা যদি হিসেবের খাতা খুলে বসি যে, নারী যখন ভ্রমণ করছিলেন তখন তার সাথে মাহরাম ছিল কিনা; তাহলে এটি হবে আরেকটি অন্যায়।

লেখক: আল মানার ইনস্টিটিউট

তথ্যসূত্র

{১}. https://www.jugantor.com/index.php/country-news/642498

{২). প্রবন্ধটি ড. শেহজাদ সেলিমের উর্দু বই ‘‘ইসলাম ও নারী’’ এবং জাভেদ আহমেদ গামিদির ওয়েবসাইটে হাদিস অধ্যায়ে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘‘মাহরামের সাথে সফর’’-এর আলোকে লেখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *