আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অনেক সাধারণ কাজ থাকে, যেখানে বাবা-মায়ের নির্দেশ মেনে চলা খুবই সহজ। যেমন, তারা এক গ্লাস পানি চাইলেন বা এক কাপ চা তৈরি করতে বললেন। এই ধরনের ছোটখাটো বিষয়ে তাদের আদেশ পালন করতে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না। এমনকি, যদি সামান্য শারীরিক বা মানসিক কষ্টও হয়, তবুও এই নির্দেশগুলো পালন করা উচিত। কারণ, এটি বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের সদ্ব্যবহারের অংশ। এক্ষেত্রে সন্তানের নিজস্ব ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার চেষ্টা করা উচিত।
প্রকৃত চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় যখন জীবনের বড় ও মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিগুলোকে দু’ভাবে দেখা যেতে পারে:
১.আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ
যদি বাবা-মা সন্তানকে এমন কোনো কাজ করতে আদেশ করেন যা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নির্দেশ বা শরিয়তের পরিপন্থী, তবে এমন পরিস্থিতিতে সন্তানের জন্য পিতা-মাতার আদেশ মানা জায়েজ নয়। যেমন—মিথ্যা বলা, কারো প্রতি অন্যায় করা, হারাম পথে অর্থ উপার্জন করা বা কোনো গোনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া। ইসলামের মৌলিক নীতি হলো, আল্লাহর আদেশের অমান্য করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“কিন্তু যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কাউকে শরিক করতে চাপ দেয় যার ব্যাপারে তোমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে ভালো আচরণ করো, আর তুমি ওই লোকদের পথ অনুসরণ করো যারা আমার প্রতি মনোযোগী।” (সুরা লুকমান : ১৫)
তাই এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পিতা-মাতাকে বোঝাতে হবে যে, আমি এই কাজটি করতে অপারগ। কারণ এটি আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী। কিন্তু পিতা-মাতার সাথে বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই, শুধু আদবের সাথে সত্য তুলে ধরতে হবে।
২. ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়
পিতা-মাতার চাওয়া বা পরামর্শ সরাসরি শরিয়ত বিরোধী না হলেও, সন্তানের নিজস্ব জীবন পরিকল্পনা, পেশা নির্বাচন, বিবাহ বা বাসস্থান সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের সাথে ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাবা-মা হয়তো চান সন্তান একটি নির্দিষ্ট পেশায় যুক্ত হোক, কিন্তু সন্তানের আগ্রহ অন্য কোনো পেশায়, অথবা বাবা-মা নির্দিষ্ট কোনো মানুষকে পাত্র/পাত্রী হিসেবে পছন্দ করেন, কিন্তু সন্তান অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায়।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে পিতা-মাতা কেবল সন্তানকে পরামর্শ দিতে পারেন, আদেশ দিতে পারেন না। মনে রাখতে হবে যে, সন্তান একটি স্বাধীন সত্তা এবং তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। পিতা-মাতার উচিত, ভালোবাসা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপদেশ দেওয়া, কিন্তু জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। জেদ বা চাপ সৃষ্টি না করে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে তাদের পরামর্শের ইতিবাচক দিকগুলো বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, সন্তানের দায়িত্ব হলো পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। কোনো অবস্থাতেই তাদের প্রতি অসম্মানসূচক আচরণ করা যাবে না। কঠোর শব্দ বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি পরিহার করতে হবে। কুরআনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, তাদের প্রতি ‘উফ’ শব্দটিও বলো না। নিজের সিদ্ধান্তের পেছনের কারণগুলো বাবা-মাকে শান্ত ও শ্রদ্ধাপূর্ণ ভঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। এমনভাবে কথা বলা বা আচরণ করা উচিত নয় যাতে তারা অসন্তুষ্ট হন। যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভুল হয়ে যায়, তবে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। বাবা-মা যদি জেদও করেন, তবে সন্তানের উচিত ধৈর্য ধরে তাদের কথা শোনা এবং বিনয়ের সাথে নিজের ন্যায্য অবস্থানে অটল থাকা। তাদের জেদকে তাদের ভালোবাসা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, যেখানে হয়তো তারা সন্তানের কল্যাণ দেখছেন।
ইসলামে পিতা-মাতার প্রতি আনুগত্যের অর্থ অন্ধ অনুসরণ নয়, বরং এটি সম্মান, ভালোবাসা এবং প্রজ্ঞার এক গভীর সম্পর্ক। যেখানে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন হয়, সেখানে পিতা-মাতার আদেশ মান্য করা যাবে না। আর যেখানে সন্তানের ব্যক্তিগত জীবন বা বিবেকের প্রশ্ন জড়িত, সেখানে অবশ্যই পিতা-মাতার প্রতি সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার ও সম্মান বজায় রেখে সন্তান নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখে। পিতা-মাতাকে এক্ষেত্রে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে শুধু পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতে হবে। এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই পরিবারে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করে।
(উস্তাদ তালিব মহসিনের লেকচারের আলোকে)
অনুবাদ: আল মানার ইনস্টিটিউট
Leave a Reply