আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
“তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল।” (সুরা শুরা ৪২: ৩৮)
আল্লাহর রাজত্ব আরব উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই এই আদেশ নাজিল হয়েছিল। এটি নিয়ে চিন্তা করুন, এটি তিনটি শব্দের একটি বাক্য, কিন্তু এর মধ্যে অর্থের এক বিশাল জগত নিহিত রয়েছে। এর বিশদ ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:
আয়াতে প্রথম শব্দটি হলো ‘আমর’, আরবি ভাষায় এটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে এর অবস্থান প্রমাণ করে যে, এটি ‘ব্যবস্থা’ (system) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আদেশ’ (command) থেকে প্রসারিত হয়ে শব্দটিতে এই অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। যখন কোনো আদেশ অনেক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তখন তা নিজের জন্য সীমা নির্ধারণ করে এবং নিয়ম-কানুন তৈরি করে। তখন এর প্রয়োগ রাজনৈতিক ক্ষমতার নির্দেশাবলি এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা—উভয় ক্ষেত্রেই হয়। আমাদের ভাষায় ‘ব্যবস্থা’ (نظام) শব্দটি এই অর্থ প্রকাশের জন্যই ব্যবহৃত হয়।
এখানে যেহেতু কুরআন এটিকে নাম পুরুষের সর্বনাম (third-person pronoun) ব্যতীত অন্য কোনো বিশেষণ দ্বারা নির্দিষ্ট করেনি, তাই ব্যবস্থার প্রতিটি দিক এর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হবে। পৌরনীতি, জাতীয় ও প্রাদেশিক বিষয়াদি, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিধান, আইন প্রণয়নের নিয়মাবলি, ক্ষমতা অর্পণ ও হরণ, নেতা নিয়োগ ও অপসারণ, সম্মিলিত জীবনের জন্য দ্বীনের ব্যাখ্যা—মোটকথা, সম্মিলিত ব্যবস্থার সমস্ত বিষয় এই আয়াতে বর্ণিত নিয়মের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। এর কোনো শাখা এর আওতার বাইরে থাকবে না এবং কোনো অংশ এর প্রভাব থেকে মুক্ত হবে না।
এরপর আছে ‘শূরা’। এটি ‘ফু’লা’ (فعلى)-এর রূপে একটি মাসদার। এর অর্থ হলো পরামর্শ করা। আলোচ্য আয়াতে এটি সরাসরি খবর (বিধেয়) হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বাক্যটির অর্থ আর সেটি থাকে না যা وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّه (কাজ-কর্মে তাদের পরামর্শ নিন। এরপর যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন) [সুরা আলে ইমরান: ১৫৯] আয়াতে আছে। যদি সেই কথাই বলা উদ্দেশ্য হতো, তবে শব্দগুলো সম্ভবত এমন হতো: ‘وَفِي الْأَمْرِ هُمْ يشَاورُونَ’ (এবং বিষয়গুলোতে তাদের সাথে পরামর্শ করা হয়)। এই পরিস্থিতিতে এটি আবশ্যক ছিল যে, সমাজ আগেই শাসক ও শাসিত—এভাবে বিভক্ত হয়ে থাকবে। শাসক হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হতেন, অথবা ক্ষমতা জোরপূর্বক দখল করে নিতেন, অথবা কোনো মাসুম ইমাম তাকে মনোনীত করতেন। যাই হোক, তিনি যেখান থেকেই আসতেন এবং যেভাবেই নেতৃত্বের পদে পৌঁছতেন, তিনি কেবল এই বিষয়ে বাধ্য থাকতেন যে, জাতীয় বিষয়ে কোনো মতামত প্রতিষ্ঠার আগে মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের বা সকলের মতামত মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা তার উপর আরোপ করা যেত না। মতামত গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা তার হাতেই থাকত। তিনি চাইলে কারো মতামত গ্রহণ করতেন এবং চাইলে কোনো দ্বিধা ছাড়াই তা প্রত্যাখ্যান করতেন।
কিন্তু أَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ (তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল)-এর ক্ষেত্রে যে শৈলীর পরিবর্তন হয়েছে, তার দাবি হলো যে, স্বয়ং শাসকের শাসনও পরামর্শের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্যবস্থাটি পরামর্শের মাধ্যমেই অস্তিত্বে আসবে। পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার অধিকার সমান হবে। যা কিছু পরামর্শের মাধ্যমে গঠিত হবে, তা পরামর্শের মাধ্যমে ভেঙেও দেওয়া যাবে। যে জিনিসটিকে অস্তিত্বে আনার জন্য পরামর্শ করা হবে, প্রতিটি ব্যক্তির মতামত তার অস্তিত্বের অংশ হবে। যদি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত সম্ভব না হয়, তবে বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করা হবে।
আমরা আমাদের ভাষায় উদাহরণস্বরূপ যদি বলি: “এই বাড়ির মালিকানার সিদ্ধান্ত এই দশ ভাইয়ের পরামর্শে হবে,” তবে এর পরিষ্কার অর্থ হলো, এই দশ ভাই-ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং তাদের মধ্যে কারো মতামত অন্যের মতামতের ওপর প্রাধান্য পাবে না। যদি তারা সবাই সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তবে ভালো। অন্যথায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু যদি এই কথাটি এভাবে বলা হয় যে, “বাড়ির মালিকানার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এই দশ ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে,” তবে এর অর্থ হবে: সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এই দশ ভাইকে বাদ দিয়ে অন্যকোনো ব্যক্তির হাতে। মূল মতামত ওই ব্যক্তিকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তারই মতামত কার্যকর হবে। তবে মতামত প্রতিষ্ঠার আগে তার উচিত এই ভাইদের সঙ্গেও পরামর্শ করা। স্পষ্টতই, এ অবস্থায় তিনি তাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কাছেও বাধ্য থাকবেন না এবং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করাও তার জন্য আবশ্যক হবে না।
আমাদের মতে, যেহেতু মুসলমানদের সম্মিলিত ব্যবস্থার ভিত্তি হলো أَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ (তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল), তাই তাদের নেতা ও শাসকদের নির্বাচন এবং সরকার ও শাসনের প্রতিষ্ঠা পরামর্শের মাধ্যমেই হবে এবং নেতৃত্বের পদ গ্রহণ করার পরেও তারা এই অধিকার রাখেন না যে, সামাজিক বিষয়ে মুসলমানদের সর্বসম্মত বা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রত্যাখ্যান করবেন।
‘তাফহিমুল কুরআন’-এর লেখক মাওলানা সাইয়িদ আবুল আ’লা মওদুদি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
أَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
(তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল) নীতিটি তার নিজস্ব প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের কারণে পাঁচটি বিষয়ের দাবি করে:
- প্রথমত, সম্মিলিত বিষয়গুলো যেসকল মানুষের অধিকার ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে এবং তাদের বিষয়গুলো বাস্তবে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদেরকে সম্পূর্ণ অবগত রাখতে হবে। তাদের এই পূর্ণ অধিকারও থাকবে যে, যদি তারা তাদের বিষয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি বা অনিয়ম দেখতে পায়, তবে তারা তা ধরিয়ে দিতে, প্রতিবাদ করতে এবং সংশোধন না দেখলে পরিচালকদের পরিবর্তন করতে পারবে। মানুষের মুখ বন্ধ করে, তাদের হাত-পা বেঁধে এবং তাদেরকে অজ্ঞ রেখে তাদের সম্মিলিত ব্যবস্থা পরিচালনা করা স্পষ্টতই বিশ্বাসঘাতকতা, যাকে কেউই أَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ (তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল)-এর নীতির অনুসরণ বলে মনে করতে পারে না।
- দ্বিতীয়ত, সম্মিলিত বিষয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব যার ওপরই অর্পণ করা হোক, তাকে মানুষের সম্মতির মাধ্যমে নিযুক্ত হতে হবে এবং এই সম্মতি তাদের স্বাধীন সম্মতি হতে হবে। জোরপূর্বক বা ভীতিপ্রদর্শন করে অর্জিত সম্মতি অথবা লোভ ও প্রলোভন দ্বারা কিনে নেওয়া সম্মতি কিংবা প্রতারণা ও ছলনা দ্বারা ছিনিয়ে নেওয়া সম্মতি প্রকৃতপক্ষে কোনো সম্মতি নয়। কোনো জাতির প্রকৃত নেতা সে হয় যাকে মানুষ নিজের ইচ্ছায় ও খুশিতে নেতা বানায়, সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে কেউ নেতা হয়ে গেলে সে প্রকৃত নেতা হয় না।
- তৃতীয়ত, শাসককে পরামর্শ দেওয়ার জন্য এমন লোকদের নিযুক্ত করতে হবে যারা জাতির আস্থা অর্জন করেছে। এমন লোক কখনোই প্রকৃত অর্থে আস্থার অধিকারী হতে পারে না যারা চাপ প্রয়োগ করে বা অর্থ দিয়ে কিনে অথবা মিথ্যা ও ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে কিংবা মানুষকে বিভ্রান্ত করে প্রতিনিধিত্বের পদ লাভ করে।
- চতুর্থত, পরামর্শদাতারা তাদের জ্ঞান, বিশ্বাস ও বিবেকের ভিত্তিতে মতামত দেবেন এবং এগুলোর ভিত্তিতে মতামত দিতে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। যেখানে এটি নেই, যেখানে পরামর্শদাতারা কোনো লোভ বা ভয়ের কারণে অথবা কোনো দলীয় শৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকার কারণে নিজেদের জ্ঞান ও বিবেকের বিরুদ্ধে মতামত দেয়, সেখানে প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা ও গাদ্দারি হয়, أَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ (তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল)-এর অনুসরণ হয় না।
- পঞ্চমত, যে পরামর্শ শূরা-সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে দেওয়া হয়, তা মেনে নিতে হবে। কারণ, যদি একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠী সবার কথা শোনার পর নিজের মনমতো কাজ করার ক্ষমতা রাখে, তবে পরামর্শ সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা এটি বলছেন না যে, “তাদের বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়,” বরং তিনি বলছেন: “তাদের বিষয়গুলো পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে চলে।” এই আদেশের বাস্তবায়ন কেবল পরামর্শ নেওয়ার মাধ্যমেই হয় না, বরং এর জন্য আবশ্যক হলো, সর্বসম্মতিক্রমে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হবে, তা অনুযায়ী বিষয়গুলো পরিচালিত হতে হবে।” (তাফহিমুল কুরআন ৪/৫০৯)
নবী (স.) এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই তাঁর ইন্তেকালের কিছুকাল আগে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তাঁর পর কুরাইশের সাহাবিগণ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন, আনসার নয়। তিনি বলেছেন:
إِنَّ هَذَا الْأَمْرَ فِي قُرَيْشٍ لَا يُعَادِيهِمْ أَحَدٌ إِلَّا كَبَّهُ اللَّهُ فِي النَّارِ عَلَى وَجْهِهِ مَا أَقَامُوا الدِّينَ
“এই ক্ষমতা কুরাইশদের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। এই বিষয়ে যে ব্যক্তিই তাদের বিরোধিতা করবে, আল্লাহ তাকে উপুড় করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।” (বুখারী, হাদিস নং ৭১৩৯)
এই সিদ্ধান্তের কারণ তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
النَّاسُ تَبَعٌ لِقُرَيْشٍ فِي هَذَا الشَّأْنِ مُسْلِمُهُمْ تَبَعٌ لِمُسْلِمِهِمْ وَكَافِرُهُمْ تَبَعٌ لِكَافِرِهِمْ
“এই বিষয়ে মানুষ কুরাইশের অনুসারী। আর মুসলিমগণ কুরাইশের মুসলিমদের অনুসারী এবং আরবের কাফিররা কুরাইশের কাফিরদের অনুসারী।” (বুখারী, হাদিস নং ৩৪৯৫)
এভাবে নবী (স.) সম্পূর্ণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আরবের মুসলমানদের আস্থা যেহেতু কুরাইশদের ওপর, তাই কুরআন মাজিদের নির্দেশনা — أَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ — (তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল-এর আলোকে সমগ্র আরবে তাদের ব্যতীত অন্য কেউ সাধারণ নেতৃত্বের যোগ্য হতে পারে না। আর ক্ষমতা হস্তান্তরের এই সিদ্ধান্ত কোনো বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা জন্মগত অগ্রাধিকারের কারণে নয়, বরং তাদের প্রতি মানুষের এই আস্থার কারণেই করা হয়েছিল।
মুল: উস্তাদ জাভেদ আহমেদ গামিদি (বই: মিজান)
অনুবাদ: মাওলানা উমর ফারুক
Leave a Reply