সহিহ হাদিস ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে মালহামা (মহাযুদ্ধ) কী?

admin Avatar

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মালহামা বা আল-মালহামাতুল কুবরা হলো একটি রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ, যা কিয়ামতের আগে মুসলিম ও রোমানদের মধ্যে সংঘটিত হবে, যার নেতৃত্ব দিবেন মাহদি (আ.)। এরপর দাজ্জাল আগমন করবে এবং ঈসা (আ.) নেমে এসে তাকে হত্যা করবেন।

এই ধারণার ভিত্তিতে সাধারণত যেসব হাদিস বর্ণনা করা হয়, সেগুলোর অধিকাংশই সনদের দিক থেকে দুর্বল কিংবা ভিত্তিহীন। কেবল একটি হাদিসই সহিহ হিসেবে গ্রহণযোগ্য, যা সহিহ মুসলিমে এসেছে। তাই এখানে আমরা শুধু সেই সহিহ হাদিসটির আলোকে আলোচনা করব এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সেটির ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।

নিচে হাদিসটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো—

“আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন: কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না রোমানরা ‘আমাক’ অথবা ‘দাবিক’ নামক স্থানে অবতীর্ণ হবে। এরপর তাদের মুকাবিলায় মদিনা থেকে তখনকার দুনিয়ার সর্বোত্তম মানুষের একদল সৈন্য বের হবে। তারপর উভয়দল সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবার পর রোমানরা বলবে, তোমরা ঐ লোকেদের থেকে পৃথক হয়ে যাও, যারা আমাদের লোকেদের বন্দি করেছে। আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব। তখন মুসলিমগণ বলবে, আল্লাহর শপথ! আমরা আমাদের ভাইদের থেকে কক্ষনো পৃথক হব না। অবশেষে তাদের পরস্পর যুদ্ধ হবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশ সৈন্য পালাবে। আল্লাহ তায়ালা কক্ষনো তাদের তওবা গ্রহণ করবেন না। সৈন্যদের এক তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম শহিদ। আর সৈন্যদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয়ী হবে। জীবনে আর কক্ষনো তারা ফিতনায় আক্রান্ত হবে না। তারাই কনস্টান্টিলোপল বিজয় করবে।

তারা নিজেদের তলোয়ার জাইতুন গাছে লটকিয়ে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগ করতে থাকবে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে শয়তান উঁচু আওয়াজে বলতে থাকবে, দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বের হবে। অথচ এটি ছিল মিথ্যা সংবাদ। তারা যখন সিরিয়া পৌঁছবে তখন সত্যিই দাজ্জালের আগমন ঘটবে। যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবে, তখন নামাজের সময় হয়ে যাবে। অতঃপর ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন এবং নামাজে তাদের ইমামতি করবেন। আল্লাহর শত্রু (দাজ্জাল) তাঁকে দেখামাত্রই বিগলিত হতে শুরু করবে যেমন লবণ পানিতে গলে যায়। যদি ঈসা (আ.) তাকে এমনিই ছেড়ে দিতেন তবুও সে নিজে নিজে বিগলিত হতে হতে ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে ঈসা (আ.)-এর হাতে হত্যা করবেন এবং ঈসা (আ.) নিজ বর্শাতে তার রক্ত মানুষকে দেখাবেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নাম্বার: ২৮৯৭)

প্রচলিত ব্যাখ্যার সমস্যা:

সাধারণ ধারণা হলো, হাদিসে যেভাবে ঘটনা বলা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে হুবহু ঘটবে। কিন্তু এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে:

১. কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) তো ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয় হয়েছে। তাহলে হাদিসে কনস্টান্টিনোপলের আগে-পরে যেসব ঘটনা বলা হয়েছে, সেগুলো কেন ঐ সময় ঘটেনি?

২. হাদিসে তলোয়ার-ভিত্তিক যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। ভবিষ্যতের যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্র থাকবে না? মানুষ কি আবার ঢাল-তলোয়ার ব্যবহার করবে? এটা বাস্তবতার সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?

আমাদের মতে হাদিসের ব্যাখ্যা:

আমরা মনে করি, এই হাদিসে যা বলা হয়েছে, তা মূলত একটি স্বপ্ন ছিল, যা রাসুলুল্লাহ (স.)-কে আল্লাহর তরফ থেকে দেখানো হয়েছে। আর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর স্বপ্ন যেহেতু পুরোপুরি সত্য হয়, তাই বর্ণনাকারীগণ এটিকে একটি বাস্তব ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার যে, স্বপ্নে অনেক বিষয় উপমাস্বরূপ দেখানো হয়, যা বাস্তব দুনিয়ায় হুবহু ঘটে না, বরং তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোনোকিছু ঘটে। এজন্য স্বপ্নের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। যেমন কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, হজরত ইউসুফ (আ.) স্বপ্নে দেখেছিলেন, এগারোটি তারকা ও চাঁদ-সূর্য তাঁকে সেজদা করছে। আমরা সবাই জানি, এখানে এগারো তারকা মানে তাঁর এগারো ভাই এবং চাঁদ-সূর্য মানে তার পিতামাতা ছিলেন। এছাড়াও স্বপ্ন যেহেতু উপমা হয়, তাই একটি ঘটনার পর আরেকটি ঘটনা শত শত বছর পরে সংঘটিত হলেও স্বপ্নে তা একসাথে দেখানো হয়।

এখন আসুন, হাদিসে যে দৃশ্যগুলো এসেছে, তা বাস্তবে কীভাবে ঘটেছে বা ঘটতে পারে, তার একটি ব্যাখ্যা দেখি:

১. রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ:

‘আমাক’ ও ‘দাবিক’ হচ্ছে সিরিয়ার আলেপ্পোর কাছে। রোমানদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয় ছিল সিরিয়ায়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সিরিয়া জয় করে। এই যুদ্ধ ছিল বড় পরিসরে মুসলিম-রোমান সংঘাতের সূচনা, যা পরে আরও বিস্তৃত হয়। হাদিসে বর্ণিত স্বপ্নে ইয়ারমুক থেকে শুরু করে রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সকল যুদ্ধ ও বিজয়কে বুঝানো হয়েছে।

২. কনস্টান্টিনোপল বিজয়:

রোমানদের সর্বশেষ ঘাঁটি ছিল কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল)। মুসলমানদের বহু প্রচেষ্টার পর ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ তা বিজয় করেন। হাদিসে এই ঘটনাটিই ভবিষ্যৎ বিজয়ের রূপে এসেছে।

৩. দাজ্জাল এসে গেছে বলে মিথ্যা সংবাদ প্রচার:

এর মানে, যুগে যুগে কিছু মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় দাজ্জাল এসে গেছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়াবে। এগুলো বাস্তব দাজ্জালের আগমনের আগেই বিভ্রান্তি তৈরি করবে।

৪. সিরিয়ায় পৌঁছার পর সত্যিকারের দাজ্জালের আগমন:

এটি সরাসরি ভৌগোলিক ‘সিরিয়া’ নয়, বরং কালগত একটি ধাপ বোঝানো হয়েছে— বহু যুগ পার হওয়ার পর এক সময় সত্যিই দাজ্জাল (ভণ্ড মাসিহ) আগমন করবে। সে নিজেকে মাসিহ দাবি করবে, ইহুদিদের নেতা হবে, এবং মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য ভয়াবহ ফিতনা তৈরি করবে।

৫. ঈসা (আ.)-এর অবতরণ ও দাজ্জালকে হত্যা:

এর মানে, খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু হবে, যারা তাওহিদ, শরিয়ত ও মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে। তারা সত্যিকার অর্থে ঈসা (আ.)-এর প্রকৃত শিক্ষাকে পুনর্জীবিত করবে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন বিস্তার লাভ করবে। অবশেষে তারা দাজ্জালকে হত্যা করবে।

উপসংহার:

কিয়ামতের পূর্বে নির্দিষ্টভাবে কোনো মহাযুদ্ধের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.) ভবিষ্যদ্বাণী করেননি। এ ব্যাপারে একমাত্র যে সহিহ হাদিসটি পাওয়া যায়, তা ছিল মূলত একটি স্বপ্ন, যা রাসুলুল্লাহ (স.)-কে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছিল। এই স্বপ্নের একাংশ রোমান-মুসলিম যুদ্ধ ও কনস্টান্টিলোপল বিজয়ের মাধ্যমে ইতিহাসে বাস্তবায়িত হয়েছে। আরেক অংশ —দাজ্জালের আগমন ও ঈসা (আ.)-এর অবতরণ— এখনো বাকি আছে, যা কিয়ামতের পূর্বে বাস্তবায়িত হবে।

লেখক: মাওলানা উমর ফারুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *