ইসলামে কেন গণতন্ত্র অপরিহার্য?

admin Avatar

রাষ্ট্র হলো একটি সামষ্টিক প্রতিষ্ঠান, তাই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বর্তমান পৃথিবীতে এই অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। গণতন্ত্র ইতিহাসের নানান বিবর্তনের পথ অতিক্রম করে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের মতামত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কোনো নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন এবং বাতিল করাকে পারিভাষিক অর্থে গণতন্ত্র বলে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করার সাথে ইসলামের কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। উপরন্তু, কুরআনের একটি আয়াতের মাধ্যমে আমরা এটাও জানতে পারি যে, মুসলিমদের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হবে তাদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে।

আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:

তাদের ব্যবস্থাপনা পারস্পরিক পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল। (সূরা শুরা: ৩৮)

একটি কথা আমাদেরকে ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে, ইসলামে একনায়কতন্ত্র বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর শাসন ব্যবস্থার কোনো স্থান নেই। গণতন্ত্রের বিষয়ে মুসলিমরা অনেক আপত্তি উত্থাপন করে। আজকের এই আলোচনায় আমরা সেই আপত্তিগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখব যে, তা কতটুকু মজবুত বা গ্রহণযোগ্য।

১. গণতন্ত্রের বিষয়ে প্রথম যে আপত্তি উত্থাপন করা হয় তা হলো, গণতন্ত্র অধিকাংশ মানুষের মতামতের অনুসরণ করার কথা বলে, কিন্তু পবিত্র কুরআনে অধিকাংশ মানুষের মতামতকে অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই ইসলামে গণতন্ত্র জায়েজ হতে পারে না।

এক্ষেত্রে তারা কুরআন থেকে যে আয়াতটি পেশ করে তা হলো:

পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা যদি আপনি শোনেন, তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। এরা শুধু ধারণার ওপর চলে এবং আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে। (সূরা আনআম: ১১৬)

যদিও এই আয়াতে অধিকাংশ মানুষের কথা গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্রব্যবস্থা বা গণতন্ত্রের জন্য নয়। আমরা যদি এই আয়াতের পূর্বের ও পরবর্তী আয়াতের যোগসূত্রের দিকে লক্ষ করি, তাহলে আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে পারব। মূলত এই আয়াতে আল্লাহ অবিশ্বাসীদের একটি আপত্তির জবাব দিয়েছেন। মাক্কি যুগে অবিশ্বাসীরা আপত্তি করত, ইসলাম যদি সত্য ধর্ম হয়ে থাকে, তাহলে বেশি সংখ্যক মানুষ কেন ইসলাম গ্রহণ করছে না। অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সত্য ও মিথ্যার মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। এ কারণেই আল্লাহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ পরবর্তী আয়াতে বলেছেন:

বাস্তবতা হচ্ছে, আপনার প্রভু খুব ভালো করেই জানেন, কারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং যারা সঠিক পথে রয়েছে তাদেরকেও তিনি খুব ভালো করেই জানেন। (সূরা আনআম: ১১৭)

মূল কথা হলো, ইসলাম সত্য ধর্ম নাকি মিথ্যা, তা মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করে না। পৃথিবীতে যদি একজন মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তাহলেও ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র সত্য ও গ্রহণযোগ্য ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে। অতএব, এই আয়াতের সাথে রাষ্ট্রব্যবস্থা বা গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি এই আয়াতের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ইসলামবিরোধী মতবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চায়, তাহলে এটি হবে কুরআনের আয়াত নিয়ে তামাশা করা।

২. এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা কি বৈধ? এছাড়াও গণতন্ত্রের মাধ্যমে মুসলমানদের কী পাওয়ার আছে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, পবিত্র কুরআনে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে নিষেধ করা হয়নি। এমনকি আকার-ইঙ্গিতেও নিষেধ করা হয়নি যে, মুসলমানরা রাজনৈতিক দল তৈরি করতে পারবে না। যেহেতু নিষেধ করা হয়নি, সুতরাং রাজনৈতিক দল তৈরি করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোনো বাধা নেই।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা একটি জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব। তবে এক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনা মেনে চলব। কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা যে প্রতিনিধি নির্বাচন করব, তাকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ এবং জ্ঞানী হতে হবে।

সূরা বাকারার ২৪৭ নম্বর আয়াতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, শাসক হওয়ার জন্য অধিক ধন-সম্পদের প্রয়োজন নেই, বরং জ্ঞান এবং নৈতিকতা প্রয়োজন।

বলা হয়েছে:

(তাদের চাওয়া অনুযায়ী) তাদের নবী তাদেরকে বললেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য তালুতকে রাজা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। তখন তারা বললো, আমাদের ওপর এই লোকের রাজত্ব কীভাবে চলতে পারে? যখন রাজত্বের জন্য আমরা তার চেয়ে বেশি যোগ্য, তাছাড়া সে কোনো সম্পদশালী লোকও নয়। তাদের নবী বললেন, আল্লাহ তাকেই তোমাদের ওপর (রাজত্ব করার জন্য) নির্বাচিত করেছেন আর (এর জন্য) তাকে জ্ঞান ও দেহে বড় উন্নতি দান করেছেন। (এটি আল্লাহর রাজত্ব)। আর আল্লাহ তার এই রাজত্ব (নিজের প্রজ্ঞা অনুযায়ী) যাকে চান তাকে দান করেন। (তোমরা যে কোনো বিষয়কে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখো)। আর আল্লাহ খুবই উদার দৃষ্টিসম্পন্ন, তিনি সবকিছু জানেন। (সূরা বাকারা: ২৪৭)

৩. গণতন্ত্র বনাম খিলাফত

মুসলমানরা সব সময় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে খিলাফত নামক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা উত্থাপন করে। যদিও এই খিলাফতের প্রকৃত স্বরূপ ঐতিহাসিকভাবে আমরা খুব কম সময়ের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। এছাড়াও আধুনিক সময়ে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো মতাদর্শের ধারণা যতটা স্পষ্ট হওয়া দরকার, মুসলমানদের উত্থাপিত খিলাফতের ধারণা ততটা স্পষ্ট নয়। সব থেকে বড় কথা হলো, খিলাফত ইসলামের কোনো বিধান নয়; এটি নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতের মতো ইসলামের কোনো পরিভাষাও নয়। পবিত্র কুরআনে খিলাফত শব্দটি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বা সাধারণ অর্থে শাসনক্ষমতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। খিলাফত নামে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা মুসলমানরা তৈরি করেছে, তা প্রকৃতপক্ষে শরিয়তের কোনো বিধান নয়। যাইহোক, যেহেতু কুরআনের সাথে গণতন্ত্রের সাংঘর্ষিকতা নেই, সুতরাং ‘খিলাফত বনাম গণতন্ত্র’ এ ধরনের আলোচনারও কোনো ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের আল মানার ইনস্টিটিউট ওয়েবসাইট থেকে ‘খিলাফত’ শিরোনামের প্রবন্ধটি পড়তে পারেন। এছাড়াও লেখক ও অনুবাদক মাওলানা উমর ফারুক ‘খিলাফত কি ইসলামের দেওয়া কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা?’ শিরোনামে একটি ভিডিও আলোচনা করেছেন; আগ্রহী পাঠকরা আমাদের আল মানার ইনস্টিটিউট ইউটিউব চ্যানেল থেকে সেই আলোচনাটি দেখতে পারেন। কমেন্টে আমি লিংক যুক্ত করে দেব।

৪. রাসুল (সা.)-এর যুগে গণতন্ত্রের রূপ কেমন ছিল? এছাড়াও পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কীভাবে গণতন্ত্র হতে পারে?

আমি আগেই বলেছি, আধুনিক গণতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে নানান পথ অতিক্রম করে বর্তমানের রূপ ধারণ করেছে। রাসুল (সা.)-এর যুগে আধুনিক গণতন্ত্রের কোনো ধারণা ছিল না। তবে কুরআনের নির্দেশ এবং রাসুল (সা.)-এর কাজের মাধ্যমে আমরা এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা পাই, যেখানে মুসলিমদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। যদিও রাসুল (সা.) বলেছিলেন, কুরাইশদের মধ্য থেকে শাসক নির্বাচিত হবে, কিন্তু এটি কোনো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার নির্দেশনা ছিল না। সেই যুগে কুরাইশদের নেতৃত্বের প্রতি আরবের সকল গোত্রের মানুষের আস্থা ও সমর্থন ছিল। রাসুল (সা.) সেই আস্থা ও সমর্থন বিবেচনা করেই এ কথা বলেছিলেন। এই নির্দেশ শুধু সেই সময়ের জন্যই ছিল, এটা কোনো স্থায়ী নির্দেশ ছিল না। হযরত আবু বকর, হযরত উমর ও হযরত উসমান (রা.) সকলেই মুসলমানদের সমর্থন নিয়ে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। হযরত আলী (রা.)-এর যুগে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরম মাত্রায় বিদ্যমান থাকার পরেও তিনি মুসলমানদের একটি বড় অংশের সমর্থনে খলিফা হয়েছিলেন। এসব ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা আধুনিক গণতন্ত্রকে সমর্থন করে।

আমরা একথা বলছি না যে, পৃথিবীকে গণতন্ত্রের ধারণা ইসলামই দিয়েছে। বরং আমরা মুসলমানদেরকে বোঝাতে চাচ্ছি, ইসলামের সাথে আধুনিক গণতন্ত্রের কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। শেষবারের মতো রাসুল (সা.) আজ থেকে প্রায় ১৪ শত বছর আগে পৃথিবীতে ইসলাম নিয়ে আগমন করেছিলেন; আর আধুনিক গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে কয়েক শতাব্দি আগে। সুতরাং কেউ যদি বলে ইসলামই পৃথিবীকে গণতন্ত্র দিয়েছে, তাহলে অবশ্যই সেটা ভুল। একইভাবে কেউ যদি বলে, গণতন্ত্র ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তাহলে সেটিও মারাত্মক ভুল।

(শহিদ) ডা. মোহাম্মদ ফারুক খানের প্রবন্ধের আলোকে
লেখক: ইবনে আনিস ইবনে ইসমাইল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *