মানুষের ফিতরাতের মধ্যে পরিবার গঠনের তাগিদ বদ্ধমূল রয়েছে। একারণেই নারী ও পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং পরিবার গঠন করে। একজন মানুষ হিসেবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যেও ফিতরাতের এই তাগিদ বিদ্যমান ছিল। তাঁর চারিত্রিক গুণে মুগ্ধ হয়ে যখন হজরত খাদিজা (রা.) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তখন তিনি তাতে রাজি হন এবং পঁচিশ বছর বয়সে হজরত খাদিজাকে তিনি বিয়ে করেন। হজরত খাদিজা (রা.) জীবিত থাকা অবস্থায় রাসুল (সা.) অন্যকোনো নারীর সঙ্গে বিবাহের কথা মনেও আনেননি। রাসুল (সা.)-এর সাথে বিয়ের আগে হজরত খাদিজা (রা.)-এর আরো দুটি বিয়ে হয়েছিল। তিনি ছিলেন বিধবা এবং তাঁর সন্তানও ছিল। হজরত খাদিজা (রা.) ছিলেন পবিত্র চরিত্রের অধিকারী একজন নারী। তাঁর চারিত্রিক পবিত্রতার জন্য তিনি ‘তাহিরা’ (পবিত্রা) উপাধিতে অভিষিক্ত ছিলেন।
তাঁদের এই পবিত্র বৈবাহিক সম্পর্ক টিকে ছিল প্রায় পঁচিশ বছর। হজরত খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর রাসুল (সা.) একা হয়ে পড়েন এবং গৃহস্থালির দায়িত্বভার বহন করা তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, খাওলা বিনতে হাকিম (রা.) হজরত খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর রাসুল (সা.)কে দ্বিতীয় বিয়ে করার পরামর্শ দেন।
তাবাকাত ইবনে সাদে উল্লেখ করা হয়েছে, খাওলা বিনতে হাকিম (রা.) বলেছিলেন:
يَا رَسُولَ اللَّه كَأَنِّي أَرَاكَ قَدْ دَخَلَتْكَ خُلَّةٌ لِفَقْدِ خَدِيجَةَ… أَفَلَا أَخْطُبُ عَلَيْكَ
“আল্লাহর রাসুল, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, খাদিজার সঙ্গ হারানোর পর আপনি কেমন জানি একা হয়ে পড়েছেন… আমি কি আপনার পক্ষ থেকে কাউকে বিবাহের প্রস্তাব দিব না?” (আত-তাবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাদ ৫/৫৭)
রাসুল (সা.) খাওলা বিনতে হাকিম (রা.)কে জিজ্ঞেস করলেন, তার খোঁজে কোনো উপযুক্ত পাত্রী আছে কিনা? খাওলা বিনতে হাকিম (রা.) জবাবে বললেন, তার খোঁজে বিবাহ উপযুক্ত একজন কুমারী ও একজন বিধবা নারী আছেন। রাসুল (সা.) জানতে চাইলেন, কুমারী কে? খাওলা বিনতে হাকিম (রা.) উত্তরে বললেন: আপনার প্রিয়তম বন্ধু আবু বকর (রা.)এর কন্যা, আয়েশা। এরপর রাসুল (সা.) জানতে চাইলেন, বিধবা কে? উত্তরে খাওলা বিনতে হাকিম (রা.) বললেন: সাওদা বিনতে যামাআ, যিনি ইতোমধ্যে ঈমান এনেছেন। রাসুল (স.) খাওলা বিনতে হাকিম (রা.)কে বললেন: তবে তাদের সঙ্গে কথা বলো। খাওলা (রা.) যখন উভয় পরিবারের সঙ্গে কথা বললেন, তখন দুপক্ষ থেকেই সম্মতি জানানো হলো।
যেহেতু সরাসরি নবী (সা.) খাওলা (রা.)কে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, তাই নবী (সা.)-এর পিছিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ফলে রাসুল (সা.) উভয়কে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং সাওদা বিনতে যামাআ (রা.)কে বিবাহের সাথে সাথেই ঘরে নিয়ে এলেন। মূলত সাওদা বিনতে যামাআ (রা.) ছিলেন একজন বিধবা এবং বয়সে রাসুল (সা.)এর কাছাকাছি। তাই তিনি গৃহস্থালির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের উপযুক্ত ছিলেন। চার বছর পর আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)কে অনুরোধ করলেন, যেন তিনি হজরত আয়েশা (রা.)কে তাঁর ঘরে নিয়ে যান। তখন রাসুল (সা.) চিন্তা করলেন যে, একজন বিধবা ও বয়স্কা নারী ঘরে থাকা অবস্থায় যদি একজন কুমারীকে আনা হয়, তাহলে এতে ঐ বিধবা নারীর অভিযোগ থাকতে পারে। তাই তিনি হজরত সাওদা (রা.)কে প্রস্তাব দিলেন যে, আপনার যদি কষ্ট হয়, তাহলে আমি আপনাকে তালাক দিতে পারি।
এ কথা শুনে হজরত সাওদা (রা.) বিনীতভাবে বললেন: “আমি এমন এক বয়সে উপনীত হয়েছি, যেখানে দাম্পত্য সম্পর্কে আর কোনো আগ্রহ বা আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি আমার সকল অধিকার আয়েশার জন্য ছেড়ে দিতে রাজি আছি। আপনি আমাকে তালাক দিবেন না। আমার একান্ত আকাঙ্ক্ষা, কিয়ামতের দিন আমি যেন আপনার স্ত্রীদের কাতারে দাঁড়াতে পারি। এই আন্তরিক আবেদন শুনে রাসুল (সা.) তাঁকেও স্ত্রী হিসেবে রাখলেন। কিন্তু কার্যত হজরত আয়েশা (রা.) তখন রাসুল (সা.)-এর দাম্পত্যসঙ্গিনী ছিলেন।
মানুষ মুহাম্মদ হিসেবে নবী (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় মোট এই তিনটি বিয়েই করেছিলেন।
অতএব যারা তাঁকে বহু বিবাহের অযাচিত অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং তাঁর পবিত্র ও নিষ্কলুষ জীবনের ওপর কুৎসার ছিটে ফেলতে চায়—তাদের সম্পর্কে কেবল এ কথাই বলা যায়; তাদের হৃদয়ে আল্লাহভীতির কোনো স্থান নেই।
নবী (সা.)-এর জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর কেউ তাঁর চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কে একটিবারের জন্যও প্রশ্ন তোলার সাহস করেনি। যৌবনের পূর্ণ উচ্ছ্বাসে তিনি বিবাহ করেন এক বিধবা ও সন্তানসম্পন্ন নারীকে। এমন এক আরব সমাজে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে একাধিক বিবাহ ছিল সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু প্রায় পঁচিশ বছর একজন স্ত্রীর সঙ্গেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেন এবং কখনো দ্বিতীয় বিবাহের কথা চিন্তাও করেননি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরই তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন — এবং তাও এক পঞ্চাশোর্ধ্ব বিধবা নারীকে। তিনি সারাজীবনে কেবল একজন কুমারী নারীকে বিবাহ করেন এবং সেই নারীকে দীর্ঘদিন পর নিজের ঘরে এনেছিলেন। কারণ বয়সে বড় যে স্ত্রীকে গৃহস্থালির দায়িত্ব পালনের জন্য ঘরে আনা হয়েছে, তিনি যেন উপেক্ষিত বা অবহেলিত বোধ না করেন। এমন এক মানুষ সম্পর্কে কেউ যদি এই ধারণা পোষণ করে যে, পঞ্চান্ন বছর বয়সে এসে হঠাৎ তিনি একাধিক বিবাহে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং নিজেই নিজের বানানো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একের পর এক নারীকে বিবাহ করেন — তাহলে এমন ধারণা একমাত্র বিকৃত মানসিকতার কোনো অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষেই করা সম্ভব।
তবে জীবনের শেষ আট বছরে নবী (সা.) আরও আটজন নারীকে বিবাহ করেছিলেন। এই বিবাহগুলোর জন্য বিশেষ বিধানও নাজিল হয়েছিল। এইসব বিবাহ একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তিনি করেননি, এবং এগুলোতে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা কামনা-বাসনা ছিল না। বরং আল্লাহর শেষ রাসুল হিসেবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য সম্পূর্ণই আল্লাহর নির্দেশে তিনি এইসব বিবাহ করেছিলেন। একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি যদি নিজেকে অন্ধ পক্ষপাত থেকে মুক্ত রেখে এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করে, তাহলে সে এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারবে না।
এখন নিচে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো:
১. বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বহু মুসলমান শহিদ হন। তাঁদের স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের লালন-পালন মদিনার মতো ছোট্ট রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ নির্দেশ দেন, যদি কোনো ব্যক্তি এই আশঙ্কা করেন যে, এতিমদের সম্পদ, অধিকার ও ভবিষ্যৎ রক্ষার দায়িত্ব তাঁরা একা পালন করতে পারবেন না, তবে তাদের উচিত —এতিমদের মায়েদের মধ্য থেকে যাদের সঙ্গে বৈধভাবে তাদের বিবাহ হতে পারে, তাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। এর মাধ্যমে ঐ নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং তাদের সন্তানদের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
এটি এমন এক নির্দেশ, যা স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। নিয়মানুসারে সর্বাগ্রে এই নির্দেশ পালনের দায়িত্ব আল্লাহর শেষ রাসুল (সা.)-এর উপরই বর্তায়। তাই তিনি তিনজন বিধবা নারীকে বিবাহ করেছিলেন। এই তিনজন মহীয়সী নারী হলেন: হাফসা বিনতে উমর (রা.), জয়নব বিনতে খুযায়মা (রা.) এবং উম্মে সালমা বিনতে আবি উমাইয়া (রা.)।
২. কুরআনে যখন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সমাজে দাসদের মর্যাদা উন্নীত করার জন্য নানান দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়, তখন নবী (সা.) স্বয়ং এই নির্দেশনার বাস্তব রূপ দেখানোর জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর ফুফাতো বোন সাইয়্যিদা জয়নব বিনতে জাহশ (রা.)-এর বিবাহ দেন তাঁরই মুক্তকৃত দাস সাহাবি ও পালকপুত্র হযরত জায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে। এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত, যা আরব সমাজে বিদ্যমান সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই দাম্পত্য সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। উভয়ের মধ্যে বনিবনা হয়নি এবং শেষপর্যন্ত জায়েদ (রা.) স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই বিচ্ছেদ ছিল সাইয়্যিদা জয়নব (রা.)-এর জন্য গভীর বেদনাদায়ক ও মানসিকভাবে চরম দুঃখজনক একটি ঘটনা।
একদিকে এই মহীয়সী নারী সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে একজন মুক্ত দাসকে বিবাহ করার মতো সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, যা সেই সময়কার আরব সমাজে অত্যন্ত বিরল ঘটনা ছিল। অপরদিকে তিনি তালাকপ্রাপ্তও হন, যা তাঁর জন্য ছিল এক গম্ভীর মানসিক আঘাত। তাঁকে মানসিক সান্ত্বনা দেওয়ার পাশাপাশি ‘পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম’ — জাহিলি যুগের এই বদ্ধমূল বিশ্বাসকে চূর্ণ করার জন্য আল্লাহ সরাসরি নবী (সা.)কে নির্দেশ দেন: যেন তিনি নিজেই সাইয়্যিদা জয়নব (রা.)-কে বিবাহ করেন। এই নির্দেশ যখন দেওয়া হয়, তখন নবী (সা.)-এর ইতোমধ্যে চারজন স্ত্রী ছিলেন। তথাপি আল্লাহর এই বিশেষ আদেশ অনুসারে তিনি সাইয়্যিদা জয়নব (রা.)কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।
এই বিষয়ে কেউ যেন কোনো আপত্তি না তোলে, সেজন্য সতর্কবাণী হিসাবে আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দেন: নবী মুহাম্মদ (সা.) হলেন শেষ নবী। অতএব, এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কার তাঁকেই সম্পন্ন করতে হবে। কারণ এমন একটি কাজ করে সমাজকে পথ দেখানোর জন্য তাঁর পরে আর কেউ নবী হিসেবে আসবে না।
সাইয়্যিদা জয়নব (রা.) এবং তাঁর প্রাক্তন স্বামী জায়েদ (রা.)-এর মধ্যকার পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল, যেখানে নবী (সা.) নিজেও মনে করতেন, এ অবস্থায় তাঁকেই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে তিনি তখনো তা প্রকাশ করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ নিজেই এই বিষয়ে নির্দেশ দেন এবং নবী (সা.)কে স্মরণ করিয়ে দেন যে, একজন রাসুল তাঁর দায়িত্ব পালনের সময় মানুষের প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার ভয় করেন না। তাঁকে কেবল আল্লাহর নির্দেশই অনুসরণ করতে হয়। ফলে এই বিবাহ কোনো মানবীয় কারণে নয়, বরং সরাসরি আল্লাহ নিজেই কুরআন মাজিদে এটির ঘোষণা দেন।
আল্লাহ বলেন:
وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِيٓ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَٱتَّقِ ٱللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا ٱللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى ٱلنَّاسَ وَٱللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَىٰهُۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَٰكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِيٓ أَزْوَٰجِ أَدْعِيَآئِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًاۚ وَكَانَ أَمْرُ ٱللَّهِ مَفْعُولًا (٣٧)
“(ওরা এই ফিতনা তখন সৃষ্টি করেছিল), যখন আপনি ঐ লোককে বারবার বলছিলেন যার প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন এবং আপনি নিজেও অনুগ্রহ করেছিলেন: “তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো।” তখন আপনি নিজের অন্তরে সেই কথাটি গোপন রাখছিলেন যা আল্লাহ প্রকাশ করবেন, আর আপনি মানুষকে ভয় পাচ্ছিলেন; অথচ আল্লাহ এর অধিক হকদার যে, আপনি তাকে ভয় করবেন। অতঃপর জায়েদ যখন তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিয়ে দিলাম, যাতে মুসলমানদের জন্য তাদের পালকপুত্রদের স্ত্রীদের বিয়ে করতে কোনো অসুবিধা না থাকে, যখন তাদের পালকপুত্ররা ওই স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। আর আল্লাহর আদেশ তো বাস্তবায়িত হবারই ছিল।” ( সূরা আহযাব: ৩৭)
৩. কুরআনে যখন এই বিবাহের ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন এর সাথে নবী (সা.)-এর জন্য বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধানও আল্লাহ নাজিল করেন। এই বিধান সূরা আহযাবের আয়াত ৫০-৫২ এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে।
এই বিধানে নবী (সা.)-এর জন্য একদিকে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা সংক্রান্ত সেইসব সাধারণ শর্ত শিথিল করা হয়েছে, যেগুলো অন্যান্য মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। অন্যদিকে সেখানে কিছু বিশেষ বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছে, যা সাধারণ মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এই বিশেষ বিধানে কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
প্রথমত, সাইয়্যিদা জয়নব (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহের পরও, যদি নবী (সা.) ইচ্ছা করেন, তবে নিম্নবর্ণিত তিনটি
নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের জন্য তিনি আরও বিবাহ করতে পারেন:
১. সেই উচ্চবংশীয় নারীদের সম্মান বৃদ্ধির জন্য, যারা নবী (সা.)-এর কোনো অভিযানের ফলে বন্দিনী হয়ে তাঁর অধীনে আসেন।
২. সেই নারীদের মানসিক সান্ত্বনা ও মর্যাদা দেওয়ার উদ্দেশ্যে, যারা নিছক রাসুল (সা.)কে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায় এবং সম্পর্কের আশায় স্বেচ্ছায় নিজেকে তার কাছে অর্পণ করে।
৩. সেই সব চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ও খালাতো বোনদের হৃদয় প্রশান্ত করার উদ্দেশ্যে, যাঁরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে হিজরত করেছেন এবং এ পথে তাদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন সব কিছু ত্যাগ করে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গ দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই বিবাহগুলো তিনি সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য করছেন, তাই এই স্ত্রীদের প্রতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা রাসুল (সা.)-এর ওপর আরোপিত হয় না।
তৃতীয়ত, আল্লাহ জানিয়ে দেন, এই স্ত্রীদের ব্যতীত আর কোনো নারীর সঙ্গে এখন রাসুল (সা.)-এর জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং একবার কারো সঙ্গে বিবাহ হওয়ার পর তাকে তালাক দিয়ে তার স্থলে নতুন কোনো স্ত্রীও তিনি ঘরে আনতে পারবেন না।
এখান থেকে স্পষ্ট যে, কঠিন পরিস্থিতিতে রাসুল (সা.)-এর ডাকে যে নারীগণ সাড়া দিয়েছিলেন কিংবা তাঁর কোনো অভিযানের ফলে চরম কষ্ট-দুঃখে পতিত হয়েছিলেন অথবা যাদের মনে নবী (সা.)-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল, আল্লাহ চেয়েছেন, যেন নবী (সা.) তাঁদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এটি এই নারীদের প্রতি মহান আল্লাহর পরম অনুগ্রহ ও দয়া ছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই নির্দেশ দেওয়ার কারণে রাসূল (সা.) প্রথমোক্ত উদ্দেশ্যে সায়্যিদা জুয়াইরিয়া (রা.) ও সায়্যিদা সাফিয়া (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সায়্যিদা মায়মুনা (রা.)কে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যে তিনি বিয়ে করেন এবং সায়্যিদা উম্মে হাবিবা (রা.)-এর সঙ্গে রাসুল (সা.) তৃতীয় উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, এটি ছিল একটি ধর্মীয় দায়িত্ব, যা নবুয়ত ও রিসালাতের সাথে সম্পর্কিত দায়িত্ব হিসেবে রাসুল (সা.)-এর উপর আরোপিত হয়েছিল এবং তিনি সেই দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করেছিলেন। এর সঙ্গে মানবীয় আকাঙ্ক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সাধারণ বিধান থেকে এটিকে পৃথক করা জরুরি ছিল। এজন্যই সূরা আহযাবে এর জন্য পৃথক বিধান দেওয়া হয়েছে।
লেখক: জাভেদ আহমেদ গামিদি
(বই: মাকামাত)
অনুবাদ: আল মানার ইনস্টিটিউট
Leave a Reply