ইসলামি রাজনীতি ও কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা

admin Avatar

কুরআনের দুটি আয়াত দ্বারা কিছু ইসলামি আলেম ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’ করাকে ফরজ বলে দলিল পেশ করেন। এই দুটি আয়াতের মাধ্যমে তারা ইসলামি বিধানের মধ্যে “ইকামতে দ্বীন” নামে আলাদা একটি ফরজ বিধানের বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। কুরআনের উক্ত আয়াত দুটি সম্পর্কে তাদের এমন ব্যাখ্যা আমার মতে আরবি ভাষার ব্যবহারবিধি এবং পবিত্র কুরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতএব এই আয়াত দুটি সম্পর্কে আমি আমার গবেষণা, যুক্তি ও দলিলসহ এখানে পেশ করছি।

প্রথম আয়াত:

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ

لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ

“তিনিই সে সত্তা, যিনি তাঁর রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন সকল দ্বীনের উপর এই দ্বীনকে বিজয়ী করতে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সুরা সফ, ৯)

এই আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করুন। এই আয়াতে নবী (সা.) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা তাঁর ঐ সুন্নাতের কথা বর্ণনা করেছেন, যা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে রাসুলদের আলোচনা প্রসঙ্গে স্পষ্ট বিধান হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। সে সুন্নাতটি হচ্ছে: রাসুলের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার হুজ্জাত (সত্যের চূড়ান্ত প্রমাণ) যখন কোনো জাতির সামনে স্পষ্ট হয়, তখন আল্লাহ তাঁর রাসুলকে উক্ত জাতির উপর বিজয় দান করেন।

একজন নবী তার জাতির মোকাবেলায় ব্যর্থ হতে পারেন। তবে রাসুল সর্বাবস্থায় তার জাতির উপর বিজয়ী হবেন। এই বিজয় রাসুলের জীবদ্দশাতে অথবা তার মৃত্যুর পরে তার সঙ্গী-সাথি ও সাহায্যকারীদের মাধ্যমে অর্জিত হয়। সুরা মুজাদালাতে বর্ণিত হয়েছে:

إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَٰئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ

كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ ‎

“নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ লিখে রেখেছেন, ‘আমি অবশ্যই বিজয়ী হব এবং আমার রাসুলগণও।’ নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান মহাপরাক্রমশালী। (সুরা মুজাদালাহ: ২০-২১)

নবী (সা.)-ও আল্লাহতায়ালার রাসুল ছিলেন। তাই রাসুলদের এই সুন্নাত পবিত্র কুরআনে নবী (সা.)-এর বিষয়েও বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে সাহাবিদের স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি রাসুল (সা.) অবশ্যই তার জাতি অর্থাৎ আরব মুশরিকদের উপর বিজয় অর্জন করবেন। সুরা ফাতহে বর্ণিত হয়েছে:

وَلَوْ قَاتَلَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوَلَّوُا الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا

‏ سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلُ ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا‎

“(আর যারা কুফরী করেছে) তারা যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে তারা অবশ্যই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, তারপর তারা কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। এটাই আল্লাহর বিধান — পূর্ব থেকেই যা চলে আসছে, আপনি আল্লাহর বিধানে কোনো পরিবর্তন পাবেন না।” (সুরা ফাতহ, ২২-২৩)

এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহতায়ালার এই সুন্নাত কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে? পবিত্র কুরআন থেকে স্পষ্ট যে, সাহাবিদের হুকুম দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন আরব মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করে। যুদ্ধের লক্ষ্য স্থির করা হয় এভাবে যে, আরব মুশরিকরা হয় ইসলাম কবুল করবে, না হলে তাদেরকে জমিন থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হবে।

সুরা ফাতহে বর্ণিত হয়েছে:

تُقَاتِلُونَهُمْ أَوْ يُسْلِمُونَ

“তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে অথবা তারা ইসলাম কবুল করে নিক।” (সুরা ফাতহ: ১৬)

সাহাবিদের বলা হয়েছিল তারা যেন মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করে, যতক্ষণ না আরব ভূখণ্ডে সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। আরব মুশরিকদের বলে দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যদি তাদের অবস্থান থেকে ফিরে না আসে, তাহলে তাদের পরিণতি ঐ সকল জাতির মতই হবে, যাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করার পরে তারা অস্বীকার করেছিল।

সুরা আনফালে বর্ণিত হয়েছে:

قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوا إِن يَنتَهُوا يُغْفَرْ لَهُم مَّا قَدْ سَلَفَ وَإِن يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّتُ

الْأَوَّلِينَ‎﴿٣٨﴾‏ وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ۚ فَإِنِ انتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‎﴿٣٩﴾

“যারা কুফরী করে তাদেরকে বলুন, যদি তারা বিরত হয়, তবে যা আগে হয়েছে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন। কিন্তু তারা যদি অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে পূর্ববর্তীদের (সাথে আমার আচরিত) রীতি তো রয়েছেই। তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক; যতক্ষণ না ফিতনা দূর হয় এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অতঃপর তারা যদি বিরত হয়, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কার্যাবলীর সম্যক দ্রষ্টা।” (সুরা আনফাল, ৩৮-৩৯)

সাহাবিদের সাথে আল্লাহতায়ালা ওয়াদা করেছিলেন যে, তারা এই যুদ্ধে অবশ্যই বিজয় অর্জন করবে এবং আরব ভূখণ্ডে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

সুরা নুরে বর্ণিত হয়েছে:

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে জমিনে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করবেন, যেমন তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন।” (সুরা নুর, ৫৫)

ইতিহাস সাক্ষী যে, এই ওয়াদা আল্লাহতায়ালা নবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই পূরণ করেছিলেন এবং দ্বীন-ইসলামকে আরব ভূখণ্ডের সমস্ত ধর্মের উপরে বিজয় দান করেছিলেন। রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছিলেন: “আরব ভূখণ্ডে সত্য দ্বীনের সাথে অন্য কোনো ধর্ম উপস্থিত থাকতে পারে না।” প্রকৃতপক্ষে রাসুলদের প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই সুন্নাত নবী (সা.)-এর বেলায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় এবং কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর এই বিধান সর্বাবস্থায় অটল ছিল।

উপরে উল্লিখিত সুরা সফের আয়াতে মূলত আল্লাহতায়ালার এই সুন্নাতের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। আমরা যদি আয়াতটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে স্পষ্ট হবে যে, لیظھرہ ক্রিয়ার কর্তৃকারক হিসেবে যে সর্বনামটি এসেছে, তা আরবি ভাষার নিয়ম অনুযায়ী ‘আল্লাহ’-এর স্থলবর্তী এবং কর্মকারক হিসেবে যে সর্বনামটি এসেছে সেটা ইশারা হচ্ছে الھدی অর্থাৎ দ্বীনে হক। কেননা الدین শব্দের পরে এখানে وَ لَوۡ کَرِهَ الۡمُشۡرِکُوۡنَ কথাটি যুক্ত হয়েছে। আমরা এটা জানি যে, المشرکونশব্দটি পবিত্র কুরআনে কেবলমাত্র আরব ভূখণ্ডের তৎকালীন মুশরিকদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। এজন্য الدین শব্দটির ‘আলিফ লাম’ তথা আর্টিকেল স্পষ্টত নির্দিষ্টকরণের জন্য এসেছে। সুতরাং এখানে সকল ধর্মের উপর বিজয় অর্জন বলতে শুধুমাত্র আরব ভূখণ্ডের সকল ধর্মকে বোঝানো হয়েছে, পৃথিবীর সকল ধর্ম নয়। অতএব বিশ্লেষণ অনুযায়ী আয়াতের সঠিক অনুবাদ আমরা এভাবে করতে পারি: “তিনিই তাঁর রাসুলকে হেদায়েত অর্থাৎ সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি এই দ্বীনকে (আরব ভূখণ্ডের) সমস্ত ধর্মের উপর বিজয়ী করতে পারেন, যদিও এটা মুশরিকরা অপছন্দ করে।” (সুরা সফ, ৯)

আরবি ভাষার ব্যবহার বিধি এবং পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সুরা সফের উক্ত আয়াতের সঠিক অনুবাদ মূলত এটাই হবে। আয়াতের এই অনুবাদের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয় যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের জন্য কোনো ব্যক্তির চেষ্টা ও সংগ্রামের সাথে এই আয়াতের সম্পর্ক নেই। সুরা সফের উক্ত আয়াতে রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য হল রাসুল (সা.)-এর সমর্থনে জিহাদের অনুপ্রেরণা।

রাসুল (সা.)-এর “نصرت” বা সমর্থন করা কুরআনের আলোকে তার অনুসারীদের অর্থাৎ সাহাবিদের বিশেষ দায়িত্ব। সুরা সফে আলোচনা প্রসঙ্গে দুজন সম্মানিত রাসুলের উদ্ধৃতি পেশ করে নবী (সা.)-এর অনুসারীদের সতর্ক করা হয়েছিল যে, তারা যেন ঐ রাসুলদের জাতি অর্থাৎ বনি ইসরাইলের মত রাসুল (সা.)-এর “نصرت” বা সমর্থনের দায়িত্ব আদায়ে গাফিলতি বা অলসতা না করে। এরপরে তাদেরকে সুসংবাদ দেওয়া হয় যে, আল্লাহ তার রাসুলকে অবশ্যই বিজয় দান করবেন। পরবর্তীতে এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সাহাবিদের জিহাদ করার হুকুম দেওয়া হয় এবং তাদেরকে বলা হয় যে, তারা যেন রাসুলের সাহায্য-সমর্থনেরএই দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে পালন করে।

সুরা সফের সমাপ্তি আলোচনা প্রসঙ্গে বনি ইসরাইলের সর্বশেষ রাসুল হযরত ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারি (ঈসা (আ.)-এর সাহাবি)-দের উদাহরণ পেশ করে বলা হয়, যখন তাদের রাসুল তাদেরকে সাহায্যের এই দায়িত্ব আদায়ের জন্য বলে, তখন তারা সমস্ত বাধা-বিপত্তি পেছনে ফেলে এই দায়িত্ব পালনের জন্য সামনে অগ্রসর হয় এবং আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.)-কে তার শত্রুদের উপর বিজয়ী করেছিলেন।

পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বর্ণিত এমন ঘটনাগুলো বস্তুত একই আলোচনা প্রসঙ্গে এসেছে। এই হুকুম নবী (সা.)-এর সাহাবিদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। নবী (সা.) ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে কিয়ামত পর্যন্ত এই আয়াতের হুকুম সম্পৃক্ত নয় যে, তিনি বা তারা দ্বীন-ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের চেষ্টা ও সংগ্রামকে সুরা সফের উক্ত আয়াতের সাথে সম্পৃক্ত করবেন।

দ্বিতীয় আয়াত:

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ

إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ ۖ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

“তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন ধর্ম, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নুহকে এবং যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মুসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং এতে মতভেদ করো না।” (সুরা শুরা, ১৩)

এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মোহাম্মদ (সা.) কোনো নতুন দ্বীন নিয়ে আগমন করেননি। না তার পূর্বে আগত নবীদের আলাদা কোনো ধর্ম ছিল। বরং একই দ্বীন-ইসলাম, যা সমস্ত নবীদের দেওয়া হয়েছিল এবং হযরত নুহ ও ইব্রাহিম, মুসা ও ঈসা (আ.) এই একই দ্বীন-ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং মুহাম্মদ (সা.)-ও এই দ্বীন-ইসলামের মিশন নিয়ে আগমন করেছিলেন। এরপরে বলা হয়েছে, এই দ্বীন সমস্ত নবী ও তার উম্মতদেরকে এই নির্দেশনার সাথে দেওয়া হয়েছে যে, “ اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡهِ”।

এ নির্দেশনার অর্থ কী? এর অর্থ বুঝতে হলে আয়াতের শব্দের দিকে লক্ষ্য করুন। আয়াতের শব্দগুলোর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হচ্ছে: আকিমু। এই আকিমু শব্দটি বাবে-ইফাল থেকে ফেলে-আমর অর্থাৎ আদেশসূচক ক্রিয়া হয়েছে। আরবি ভাষায় যদি এই আকিমু শব্দটি সরাসরি মাফুল বা কর্মকারকের সাথে যুক্ত হয়, তাহলে তা নিম্নেবর্ণিত দুটি অবস্থায় ব্যবহৃত হয়:

  • প্রথম অবস্থা: বস্তুগত জিনিসের ক্ষেত্রে আকিমু শব্দটি আক্ষরিক অথবা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
  • দ্বিতীয় অবস্থা: আকিমু শব্দটি বিমুর্ত বা তাত্ত্বিক বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

প্রথম অবস্থায় বস্তুগত জিনিসের ক্ষেত্রে আকিমু শব্দটির যে সকল অর্থে পবিত্র কুরআন ও আরবি সাহিত্যের ব্যবহারবিধি অনুসন্ধান দ্বারা জানা যায়, তা হচ্ছে:

১- সোজা করা বা সোজা রাখা। যেমন, اقام الدرء অর্থাৎ সে বর্শার বক্রতা দূর করেছে। اقام الصف অর্থাৎ সে কাতার সোজা করেছে।আরবি সাহিত্যে শব্দটির কিছু ব্যবহার নিচে দেখানো হলো:

সাআলবা বিন আমর বলেন: اکب علیھا کاتب بدواتہ یقیم یدیہ تارۃ ویخالف “কোনো একজন লেখক সেগুলোর ওপর তার দোয়াতের সাহায্যে নকশা এঁকে দিচ্ছিল, কখনো হাত সোজা করে আবার কখনো এর বিপরীতভাবে।”

রূপক অর্থেও এই শব্দটি আসতে পারে, যেমন: তোমার অন্তরের বক্রতা দূর কর।

ইয়াজিদ বিন খাদাক বলেন: اقیموا بنی النعمان عنا صدورکم والا تقیموا کارھین الرؤسا “ওহে নোমানের ছেলেরা! আমাদের প্রতি তোমাদের হৃদয়ের বক্রতা দূর কর। নচেৎ স্মরণ রাখ যে, তোমরা তোমাদের মাথা সোজা করতে বাধ্য হবে।”

সুরা রহমানে বলা হয়েছে: وَاَقِیْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ (আর দাঁড়ি-পাল্লায় সোজা ওজন করো ন্যায়ের সাথে) [সুরা রহমান, ৯]

আল্লাহ আরও বলেন : وَ اَقِیۡمُوۡا وُجُوۡهَکُمۡ عِنۡدَ کُلِّ مَسۡجِدٍ (প্রত্যেক নামাজের সময় নিজের মুখ আল্লাহতায়ালার দিকে সোজা রাখুন) [সুরা আরাফ, ২৯]

সুরা রুমে উল্লেখ রয়েছে: فَاَقِمْ وَجْھَکَ لِلدِّیْنِ الْقَیِّمِ (সুতরাং আপনার মুখ সোজা পথে সোজা করে রাখুন) [সুরা রুম, ৪৩]

২. কোন চলন্ত বস্তুকে থামানোর ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহার আরবি সাহিত্যে দেখা যায়। যেমন, বিশামা বিন গাদির নিজের উটের প্রশংসা করে বলেছেন: فاقام ھوذلۃ الرشاء، وان تخطی یداہ یمد بالضبع (সে কুপের নড়তে থাকা রশি স্থির করেছে, আর তার হাত ব্যর্থ হয়ে গেলে সে তার বাহু প্রসারিত করে দেয়)।

৩. কোনো বসে থাকা বস্তু বা ব্যক্তিকে ওঠানো ক্ষেত্রেও এই শব্দটি ব্যবহার হয়। যেমন, اقام الرجل (তিনি লোকটিকে উঠিয়েছেন), اقام الجدار (তিনি প্রাচীর দাঁড় করিয়েছেন)। সুরা কাহাফে উল্লেখ রয়েছে: فَوَجَدَا فِیۡهَا جِدَارًا یُّرِیۡدُ اَنۡ یَّنۡقَضَّ فَاَقَامَهٗ (অতঃপর সেখানে তারা এক প্রাচীর দেখতে পেল, যা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন সে সেটাকে দাঁড় করে দিল) [সুরা কাহাফ, ৭৭]

এখান থেকে রূপক ব্যবহার হচ্ছে: أقام السوق (তিনি বাজার বসিয়েছেন বা বাজার গরম করেছেন)।

ইবনে খুযিইমের কবিতার পংক্তি: اقا مت غزالۃ سوق الضراب لاھل العراقین حولاً قمیطا (গাজালা সারা বছর বসরা এবং কুফাবাসীদের জন্য যুদ্ধের বাজার গরম করে রেখেছিল)। সুরা নিসায় উল্লেখ হয়েছে: وَاِذَا کُنْتَ فِیْھِمْ فَاَقَمْتَ لَھُمُ الصَّلوٰۃَ (এবং যখন আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন, তখন তাদের জন্য নামাজ দাঁড় করান… [সুরা নিসা, ১০২]। সুরা কাহফে এসেছে: فَلَا نُقِیْمُ لَھُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَۃِ وَزْنًا (কিয়ামতের দিন তাদের জন্য আমি কোন প্রকার দাঁড়িপাল্লা দাঁড় করাবো না) [সুরা কাহফ, ১০৫]।

এগুলো শব্দটির ব্যবহারের প্রথম অবস্থা অর্থাৎ বস্তুগত জিনিসের ক্ষেত্রে এটার ব্যবহার। দ্বিতীয় অবস্থায় অর্থাৎ বিমূর্ত বা তাত্ত্বিক বিষয়েরে সাথে যখন এই তিনটি অর্থ সম্পৃক্ত হয়, তখন তা থেকে নিম্নোক্ত অর্থ সৃষ্টি হয়:

১. বসে থাকা বস্তু বা ব্যক্তিকে ওঠানোর অর্থ থেকে তাত্ত্বিক বিষয়ের ক্ষেত্রে অর্থ হবে: প্রকাশ করা, প্রচলন ঘটানো বা প্রয়োগ করা। যেমন, ‘اقم الحق’ (সত্য প্রকাশ করো), ‘ اقم الحد علیہ’ (তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করো)।

২. সোজা করা বা সোজা রাখার অর্থ থেকে তাত্ত্বিক বিষয়ের ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ দাঁড়াবে: ঠিকঠাক করা বা ঠিকঠাক রাখা। যেমন, সুরা তালাকে এসেছে: وَاَقِیْمُوا الشَّھَادَۃَ لِلّٰہِ (আর {সাক্ষীদাতাগণ} তোমাদের সাক্ষ্যকে আল্লাহর জন্য একদম ঠিক রাখো) [সুরা তালাক, ২]

৩. কোনো বস্তুকে থামানোর অর্থ থেকে তাত্ত্বিক বিষয়ের ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ দাঁড়াবে: একটি বিষয়কে সুস্থির, অনঢ়, সংরক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত ও বহাল করা। সুরা বাকারায় উল্লেখ রয়েছে: فَاِنْ خِفْتُمْ اَلاَّ یُقِیْمَا حُدُوْدَ اللّٰہِ(তারপর যদি তোমরা আশংকা করো যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না) [সুরা বাকারা, ২২৯] সুরা মায়িদায় উল্লেখ রয়েছে: قُلْ یٰٓاَھْلَ الْکِتٰبِ لَسْتُمْ عَلٰی شَیْءٍ حَتّٰی تُقِیْمُوا التَّوْرٰۃَ وَالْاِنْجِیْلَ وَمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکُمْ مِّنْ رَّبِّکُمْ (বলুন, হে কিতাবীরা! তাওরাত, ইনজিল ও যা তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে, তা {তোমাদের জীবনে} প্রতিষ্ঠিত ও বহাল না করা পর্যন্ত তোমরা কোন ভিত্তির উপর নও) [সুরা মায়েদা, ৬৮]।

এটাই শেষ অর্থ যেটাকে কুরআনের অধিকাংশ অনুবাদকগণ প্রতিষ্ঠিত বা কায়েম করা অথবা প্রতিষ্ঠিত বা কায়েম রাখা হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কোনো বিষয়কে নিজের জীবনে স্থায়ী, অনঢ়, সংরক্ষিত ও বহাল রাখা। আরও সহজ করে বললে, নিজের জীবনবিধান বানিয়ে ফেলা। সে হিসেবে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদি (রহ.) তার তাফসির তাফহিমুল কুরআনে সুরা মায়েদার ৬৮-নং আয়াতে উল্লিখিত حَتّٰی تُقِیْمُوا التَّوْرٰۃَ وَالْاِنْجِیْلَ-এর অনুবাদ করেছেন:

جب تک تم تورات اور انجیل اور اُن دوسری کتابوں کو قائم نہ کرو

(যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাওরাত এবং ইনজিল ও অন্যান্য কিতাবগুলিকে কায়েম না করো)।

এরপরে তিনি এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন:

تورات اور انجیل کو قائم کرنے سے مراد راست بازی کے ساتھ اُن کی پیروی کرنا اور اُنھیں اپنا دستور زندگی بنانا ہے

(তাওরাত ও ইঞ্জিল কায়েম করার অর্থ হল: ন্যায়পরায়ণতার সাথে এই গ্রন্থগুলির অনুসরণ করা এবং এগুলিকে নিজের জীবনবিধান বানানো)।

এখন আমরা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করি, আয়াতে উল্লিখিত اقیموا ক্রিয়ার কর্মকারক الدین (ধর্ম) যেহেতু একটি বিমূর্ত বিষয়, তাই প্রথম অবস্থায় বস্তুগত জিনিসের ক্ষেত্রে আকিমু শব্দটির যেসব অর্থ হয়, সেগুলো এখানে কোনোভাবেই হবে না। এটা স্পষ্ট যে, শুধু দ্বিতীয় অবস্থার অর্থগুলো হতে পারে। সে অর্গগুলোর মধ্যে প্রথম অর্থ হচ্ছে: প্রকাশ করা বা প্রয়োগ করা। প্রয়োগ করার অর্থটি এখানে অবশ্যই হতে পারতো, কিন্তু দুটি বিষয় এক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে:

প্রথম বিষয়: যদি প্রয়োগ করার অর্থ নেওয়া হয়, তাহলে আরবি ভাষার ব্যবহারবিধি অনুযায়ী উদাহরণস্বরূপ এখানে علٰی فلان (অমুকের ওপর)-এর উল্লেখ কিংবা ঊহ্য রাখা জরুরি। যেমন, اقیموا الحدود علی الناس এই বাক্যে علی الناس উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এই আয়াতে এ ধরনের কোন শব্দের না উল্লেখ রয়েছে, আর না ঊহ্য আছে বলে কোনো আলামত পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় বিষয়: প্রয়োগ করার অর্থ নিলে اقیموا الدین বাক্যটির মধ্যে এবং তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত বাক্য لا تتفرقوا فیہ-এর মধ্যে ঐ মিলটি পাওয়া যায় না, যা একটি বাক্য ও তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উচ্চতর সাহিত্যে বিদ্যমান থাকা জরুরি। একই সমস্যা দাঁড়াবে যদি এর অনুবাদ ‘প্রকাশ করা’ নেওয়া হয়। لا تتفرقوا فیہ-এর সাথে ‘প্রকাশ করা’ অর্থটির কোনো মিল দেখানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়, এটা একদম পরিষ্কার। এসব কারণে এই আয়াতে আকিমু শব্দের এই অর্থ কোনোভাবেই হতে পারে না। এরপর আরও দুটি অর্থ রয়ে যায়। সেগুলো হচ্ছে: দ্বীনকে পুরোপুরি ঠিকঠাক রাখা এবং নিজের জীবনে একদম স্থির, অনঢ়, সংরক্ষিত ও বহাল রাখা। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ পবিত্র কুরআনে সালাত কায়েম করার আদেশ। কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহতায়ালা এই হুকুমটি এই ‘আকামা’ ক্রিয়ার মাধ্যমে দিয়েছেন। আর এরপর আল্লাহতায়ালা সুরা মাআরিজে নিজেই এর অর্থ এভাবে পরিষ্কার করেছেন:

الَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ

“যারা নিজের নামাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।” (সুরা মাআরিজ, ২৩)

পুনরায় বলা হয়েছে:

وَالَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ

“আর যারা তাদের সালাতের যত্ন নেয়।” (সুরা মাআরিজ, ৩৪)

অর্থাৎ যারা নিজেদের সালাতের উপর স্থির থাকে এবং নামাজকে একদম ঠিকঠাক, অনঢ় ও বহাল রাখে। সুতরাং উক্ত আয়াতে উল্লিখিত اقیموا ক্রিয়াটি নিঃসেন্দহে এই অর্থে ব্যবহৃতহয়েছে। আল্লাহতায়ালা এই আয়াতে আমাদেরকে যখন জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি গোটা মানবজাতিকে একই দ্বীন দিয়েছেন, তখন কথার প্রসঙ্গের দাবি এটাই যে, এই দ্বীনের ব্যাপারে যে দায়িত্ব মানুষের ওপর আসে, তা এক কথায় জানিয়ে দেবেন। সে হিসেবেই আল্লাহতায়ালা বলেন: اَقِیْمُوا الدِّیْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِیْہِ (এই দ্বীনকে সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে নিজের জীবনে রক্ষণাবেক্ষণ করো এবং এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করো না। বিচ্ছিন্নতা বা تَتَفَرَّقُ তৈরি করার অর্থ হচ্ছে: মানুষ এই ইসলামের ওপর নিজের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিবর্তে কিছু অংশ পালন করে ও কিছু অংশ ছেড়ে দেয় এবং এর মধ্যে নানা রকম বিদআত প্রবেশ করায়। এই কাজ স্পষ্টতই اَقِیْمُوا الدِّیْنَ (দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো) হুকুমটির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং আয়াতের এই অর্থ নেওয়ার দ্বারা দুটি সম্বন্ধযুক্ত বাক্যের মধ্যে পুরোপুরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর ঠিক এ ধরনের হুকুম কুরআনের অন্য জায়গায়ও দেওয়া হয়েছে। যেমন, আল্লাহ বলেন: وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰہِ جَمِیْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا۵ (সবাই মিলে আল্লাহতায়ালার রশি মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না)। এই দিকনির্দেশনার সারমর্ম হচ্ছে: এই দ্বীন গ্রহণ করে আবার পুনরায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে দেননি। বরং সকল নবী এবং তাদের উম্মতদেরকে এই দ্বীন এই নির্দেশনার সাথে দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন সততার সাথে এই দ্বীনকে মেনে চলে এবং সঠিকভাবে ও সুচারুরূপে তা পালন করে, বিদআত সৃষ্টি করে এই দ্বীনের রূপ যেন তারা পরিবর্তন না করে।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আরাবি (রহ.) লিখেন: ای اجعلوہ قائمًا، یرید دائمًا مستمرًا محفوظًا مستقرًا من غیر خلاف فیہ ولا اضطراب علیہ (এটাকে সুসংহত ও স্থির রাখো। অর্থাৎ নিরবিচ্ছিন্ন, সংরক্ষিত ও সুদৃঢ় রাখো, এটার ব্যাপারে কোনো ধরনের বিবাদ-বিসংবাদ না করে এবং এটিতে চিড় না ধরিয়ে। [আহকামুল কুরআন]।

আরবি ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিত ইমাম যামাখশারির মতও তাই। তিনি তার কাশশাফ গ্রন্থে লিখেছেন: والمراد اقامۃ دین الاسلام الذی ھوتوحید اللّٰہ وطاعتہ والایمان برسلہ وکتبہ وبیوم الجزاء وسائر ما یکون الرجل باقامتہ مسلمًا (এবং এর মানে হলো: দ্বীন-ইসলাম নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা, যা আল্লাহতায়ালার তাওহিদ ও তাঁর অনুগত্য, তাঁর রাসুল, আসমানি গ্রন্থ এবং কিয়ামত দিবসের উপর ঈমান আনা। সেই সাথে ঐ সকল বিষয়কেও গ্রহণ করা, যা গ্রহণ করার মাধ্যমেই মূলত একজন মানুষ মুসলিম হতে পারে)।

আলুসি (রহ.) লিখেছেন: والمراد باقامتہ تعدیل ارکانہ وحفظہ من ان یقع فیہ زیغ والمواظبۃ علیہ (কায়েম শব্দের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে: ইসলামের বিধি-বিধানের উপর সঠিকভাবে আমল করা, সমস্ত প্রকার খারাপ বস্তু থেকে ইসলামকে হেফাজত করা এবং ইসলামের উপর নিজের আমলকে ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা) [রুহুল মাআনি]।

উস্তাদ ইমাম আমিন আহসান ইসলাহি (রহ.) লিখেছেন: ‘‘কায়েম করার অর্থ: ইসলামের যে বিষয়টি বিশ্বাস করতে হবে, তা স্বচ্ছতার সাথে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করা এবং যা পালন করতে হবে, তা সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে পালন করা। নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের দিকে এই দৃষ্টি রাখা যে, তারা যেন ইসলাম থেকে গাফিল না হয়। সেই সাথে এই ব্যবস্থাও করতে হবে যে, বিদআতি লোকজন ইসলামের মধ্যে যেন কোন প্রকার বিদআত প্রবেশ করাতে না পারে।” (তাদাব্বুরে কুরআন)।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, ইকামতে দ্বীন বা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার কোন হুকুম উক্ত আয়াতে দেওয়া হয়নি। আর না এটা ইসলামের ফরজ বিধানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বরং আল্লাহতায়ালা ঐ আয়াতের মধ্যে গোটা দ্বীন-ইসলামের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি মৌলিক নীতিগত দিকনির্দেশনা আমাদের দিয়েছেন।

কুরআন ও সুন্নাতের মাধ্যমে যে ইসলাম আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তা পরিপূর্ণভাবে নিজের জীবনে ধারণ করার হুকুম আল্লাহতায়ালা উক্ত আয়াতের মধ্যে আমাদের দিয়েছেন। আর এই হেদায়েতের দাবি অনুযায়ী আমাদের বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতা, আমাদের ইবাদত ‘নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত’, আমাদের দাওয়াত ও তাবলীগের নিয়ম পদ্ধতি, আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং যুদ্ধনীতি ইত্যাদি সমস্ত বিধি-বিধানের মধ্যে যা বিশ্বাস করার, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং যা পালন করার বিষয়, তা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। তবে তা এজন্য নয় যে, এই বিধানগুলো বা এগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটি বিধান اقیموا শব্দের অর্থের মধ্যে রয়েছে। বরং এজন্য যে, এই বিধানগুলো কুরআন মাজিদ এবং নবী (সা.)-এর সুন্নাতের আলোকে الدِّیْنَ-এর অন্তর্ভুক্ত, আর উক্ত আয়াতে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, দ্বীন ইসলামকে যেন আমরা আমাদের নিজের জীবনে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করি। সেই সাথে ইসলামকে ছিন্ন-ভিন্ন করা এবং এর মধ্যে বিদআত প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকি। এটা আলাদা কোনো বিধান নয়, বরং সবগুলো বিধানকে পরিপূর্ণভাবে পালন করার নির্দেশনা।

লেখক: উস্তাদ জাভেদ আহমেদ গামিদি

লেখাটি ত্রৈমাসিক আল-ইশরাক বাংলা দ্বিতীয় সংখ্যা জুন ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছিল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *