মসজিদে নারীদের নামাজ পড়া কি মাকরুহ?

মসজিদে নারীদের নামাজ পড়া কি মাকরুহ?
Moderator Avatar

সাধারণত মনে করা হয়, মসজিদে শুধু পুরুষদের নামাজ পড়া উচিত। নারীদের জন্য ঘরে নামাজ পড়া উত্তম। মসজিদে নামাজ পড়া তাদের জন্য অনুত্তম বা মাকরুহ।  আমাদের দেশের মসজিদগুলোতেও নারীদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেন নারীরা মসজিদে প্রবেশ করলে মসজিদ অপবিত্র হয়ে যাবে! কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কী? ইতিহাসের এই স্বীকৃত সত্য কেউ তো অস্বীকার করতে পারবেন না যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগে নারীরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। এমনকি আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, নারীরা ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে নববিতে যেতেন এবং যখন তারা ফিরতেন তখন রাস্তায় অন্ধকারের কারণে তাদেরকে চেনা যেত না। (সহিহ বুখারি : ৮৬৭, সহিহ মুসলিম : ৬৪৫)

পুরুষদের উদ্দেশ্য করে নবী (সা.) বলেছেন : “তোমরা আল্লাহর বান্দিদের আল্লাহর মসজিদসমূহে যেতে বাধা দিয়ো না।” (সহিহ বুখারি : ৯০০, সহিহ মুসলিম : ৪৪২)

মসজিদে নামাজ পড়ার যেসব ফজিলত ও গুরুত্ব হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তা থেকে নারীরা বাদ যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। যদি সেই ফজিলত থেকে তারা বাদ থাকতেন, তাহলে কেন অহেতুক কষ্ট স্বীকার করে তারা মসজিদে যেতেন? ইবন হাজম (রহ.) বলেন: “মসজিদে যাওয়ার দ্বারা নারীরা যদি অতিরিক্ত কোনো সওয়াব না পেত অথবা যদি এর দ্বারা তাদের সওয়াব কমে যেত, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো তাদের এই কষ্টকর যাত্রায় অনুমতি দিতেন না। কারণ, এটি তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা হত না।” (আল-মুহাল্লা ৩/১৩২)

যারা মসজিদে নারীদের নামাজ পড়াকে অনুত্তম বা মাকরুহ বলেন, তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে কিছু হাদিস পেশ করেন। আমরা এখন শাস্ত্রীয়ভাবে এই হাদিসগুলো যাচাই করে দেখব।

এই হাদিসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো আবু দাউদের সূত্রে ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমরা তোমাদের নারীদের মসজিদে যেতে বাধা দিয়ো না, তবে তাদের ঘরই তাদের জন্য উত্তম।” (সুনান আবু দাউদ : ৫৬৭)

এই হাদিস মূলত সহিহ, কিন্তু ‘তাদের ঘরই তাদের জন্য উত্তম’ অংশটি সন্দেহজনক। এটি কেবল হাবিব ইবন আবি সাবিতের মাধ্যমে ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, অথচ নাফি ও মুজাহিদ একই হাদিস বর্ণনা করেছেন এই অতিরিক্ত বাক্য ছাড়াই, আর তারা হাবিবের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য এবং সংখ্যায় অধিক। উপরন্তু, হাবিব মূলত ‘মুদাল্লিস’ (অস্পষ্টতা রেখে বর্ণনাকারী), এবং তিনি এখানে ‘আনআনা’-এর মাধ্যমে (অর্থাৎ, সরাসরি তিনি শুনেছেন বলে উল্লেখ না করে) বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও, এই সংযোজন ছাড়াই একই হাদিস আবু হুরায়রা, আয়িশা ও জায়েদ ইবন খালিদ (রা.) থেকেও বর্ণিত হয়েছে।

আরেকটি হাদিস আবু দাউদের সূত্রে ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, যাতে বলা হয়েছে: “নারীর ঘরে নামাজ পড়া তার উঠানে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম, আর তার ব্যক্তিগত কামরায় নামাজ পড়া ঘরের ভেতর নামাজের চেয়ে উত্তম।” (সুনান আবু দাউদ : ৫৭০)

এই হাদিস সহিহ নয়। কেননা, এতে বর্ণনাকারী হিসেবে কাতাদা রয়েছেন, যিনি মুদাল্লিস (অস্পষ্টতা রেখে বর্ণনাকারী) এবং তিনি আনআনা করে (সূত্র অস্পষ্ট রেখে) বর্ণনা করেছেন। তার আনআনা গ্রহণে শিথিলতা প্রদর্শন করা নিয়মবিরুদ্ধ। যদিও বুখারি ও মুসলিম তার কিছু বর্ণনা গ্রহণ করেছেন, তবে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, তারা কাতাদার আনআনা থেকে নির্দিষ্ট কিছু বর্ণনাই নির্বাচন করেছেন এবং সর্বক্ষেত্রে তা গ্রহণ করেননি।

এছাড়াও, আহমদের সূত্রে উম্মে হামিদ সায়িদিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে: রাসুল (সা.) তাকে বলেছেন: “তোমার ঘরে নামাজ পড়া তোমার উঠানে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম, তোমার উঠানে নামাজ পড়া তোমার বাড়ির সাধারণ স্থানে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম, আর তোমার বাড়ির সাধারণ স্থানে নামাজ পড়া তোমার কওমের মসজিদে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম, এবং তোমার কওমের মসজিদে নামাজ পড়া আমার মসজিদে নামাজ পড়ার চেয়েও উত্তম।” (মুসনাদ আহমদ : ২৭০৯০)

এই হাদিসের সনদে আবদুল্লাহ ইবন সুয়াইদ আনসারি রয়েছেন, যিনি ‘মজহুল’ (অজ্ঞাত) ব্যক্তি। এ কথা সত্য যে, কিছু হাদিস বিশারদ এগুলোকে সহিহ বলেছেন, কিন্তু তাদের বক্তব্যের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। তারা এ ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নামে বর্ণিত হাদিস যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মোটেও উচিত নয়।

লেখক: মাওলানা উমর ফারুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *